
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ সাত বছর পর আফগানিস্তানের বিপক্ষে পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নিল টাইগাররা। তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ ও তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে দুর্দান্ত জয় তুলে নিয়ে ৩–০ ব্যবধানে আফগানদের হোয়াইটওয়াশ করেছে জাকের আলি অনিকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ দল। সাইফ হাসানের ঝড়ো ফিফটি আর সাইফউদ্দিনের দারুণ বোলিংয়ে গড়া এই জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে যোগ হলো নতুন অধ্যায়—যেখানে প্রতিপক্ষ আফগানিস্তানকে নিজেদের ঘূর্ণিপাকে ফেলে তুলে নেওয়া হলো এক ঐতিহাসিক সিরিজ জয়।
২০১৮ সালে ভারতের দেরাদুনে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশের তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল বাংলাদেশের। সেই দুঃসহ স্মৃতি যেন আজকের ম্যাচে আরও একবার উসকে দিয়েছিল জাকের আলিদের। কিন্তু এবার দৃশ্যপট একেবারে উল্টো। একই রকম মরুভূমির আবহে, তবে অন্য প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ শারজাহর মাটিতে গড়ে তুলেছে প্রতিশোধের মহাকাব্য।
প্রথম দুই ম্যাচেই দাপুটে জয় পেয়ে সিরিজ নিজেদের করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। তাই শেষ ম্যাচে ছিল শুধু হোয়াইটওয়াশের মিশন। জয়ের ক্ষুধায় উজ্জীবিত টাইগাররা মাঠে নামতেই বুঝিয়ে দেয়, আজকের রাত তাদেরই।
টস হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে শুরু থেকেই ধাক্কা খায় আফগানিস্তান। টাইগারদের বোলিং আক্রমণের সামনে প্রথম পাওয়ারপ্লেতেই তিন উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় সফরকারীরা। দলীয় ৩৯ রানের মাথায় আফগানদের টপ অর্ডার ধসে পড়ে—একপর্যায়ে তাদের ব্যাটসম্যানদের মনে হয়তো ফিরে আসে আগের ম্যাচগুলোর স্মৃতি।
এরপর চতুর্থ উইকেটে দলকে টেনে তোলার চেষ্টা করেন ডারউইশ রাসুলি ও সেদিকউল্লাহ আতাল। দুজন মিলে ৩৪ রানের জুটি গড়ে কিছুটা আশা জাগালেও সেটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সাইফউদ্দিনের নিখুঁত লেন্থে বল এক পর্যায়ে সেদিকউল্লাহকে (২৮) ফিরতে বাধ্য করে।
এরপর শুরু হয় আফগান ব্যাটিংয়ের ধ্বস। একের পর এক ব্যাটার সাজঘরে ফিরতে থাকেন, স্কোরবোর্ডে রান বাড়ে খুব ধীরে। এক পর্যায়ে ৮ উইকেটে ৯৮ রান—সেখান থেকে ১২০ রান পার হবে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছিল।
শেষদিকে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন রাসুলি ও মুজিব উর রহমান। শেষ ৩৪ রানে তাদের জুটি আফগানিস্তানকে অন্তত লড়াইয়ের যোগ্য সংগ্রহ এনে দেয়। বিশেষ করে মুজিবের ঝড়ো ২১ রানের ইনিংস (মাত্র ৩ চারে) দলকে ১৪৩ রানে পৌঁছে দেয়। রাসুলি দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩২ রান করেন।
বাংলাদেশের পক্ষে আজকের দিনে সবচেয়ে প্রশংসিত পারফর্মার নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। চোটের পর দলে ফিরে এই পেসার যেন নিজের পুরোনো ছন্দে ফিরে এসেছেন। তিনি মাত্র ১৫ রান দিয়ে নিয়েছেন ৩টি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট, যার মধ্যে দুটি ছিল পাওয়ারপ্লেতে।
স্পিনার নাসুম আহমেদ ও তরুণ তানজিম হাসান সাকিবও ছিলেন দুর্দান্ত। দুজনই নিয়েছেন দুটি করে উইকেট। তাঁদের বোলিংয়ের ধারাবাহিক চাপে আফগান ব্যাটাররা উইকেটে স্থায়ী হতে পারেননি। পুরো ইনিংসজুড়ে টাইগারদের ফিল্ডিংও ছিল শৃঙ্খলাপূর্ণ—কোনো বড় ভুল হয়নি, আর সেটিই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।
১৪৪ রানের মাঝারি লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের শুরুটা ছিল সতর্ক। ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন ১৪ রান করে ফিরলেও অপরপ্রান্তে তানজিদ হাসান তামিম ও সাইফ হাসান শুরু থেকেই দেখিয়েছেন ইতিবাচক মানসিকতা।
পাওয়ারপ্লে শেষ হওয়ার পরপরই ম্যাচের গতি বাড়ে সাইফের ব্যাটে। আফগান বোলারদের ওপর চাপ বাড়াতে তিনি ছক্কার বন্যা বইয়ে দেন। তানজিদ ৩৩ রানে আউট হলেও ততক্ষণে বাংলাদেশ ম্যাচে শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলে।
এরপর ক্রিজে আসেন অধিনায়ক জাকের আলি অনিক, যিনি সাইফের সঙ্গে গড়ে তোলেন ৫০ রানের দারুণ জুটি। ইনিংসের শেষভাগে সাইফের ব্যাট যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে—আহমেদজাইয়ের ওভারে একাই নেন ১৫ রান, যার মধ্যে একটি বিশাল ছক্কা গ্যালারির ছাদে গিয়ে পড়ে। সেই ছক্কাতেই তিনি পৌঁছে যান নিজের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের চতুর্থ অর্ধশতকে।
শেষদিকে উইকেটে নেমে নুরুল হাসান সোহানও মারেন এক দৃষ্টিনন্দন ছক্কা, যা ম্যাচের শেষটানে এনে দেয় জয়ের সুর। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেট হাতে রেখে জয় তুলে নেয় ১৭ বল বাকি থাকতে—যা পুরো সিরিজের প্রাধান্যকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
দলের প্রয়োজনের সময় দায়িত্বশীল ইনিংস খেলার পাশাপাশি দৃষ্টিনন্দন শট খেলেছেন সাইফ হাসান। তাঁর ৫০ রানের ইনিংসে ছিল ৫ চার ও ৩ ছক্কা, স্ট্রাইক রেট ১৪৫-এরও বেশি। টেকনিক, সাহস আর আত্মবিশ্বাসের মিশ্রণে তৈরি এই ইনিংস ছিল তাঁর ক্রিকেট পরিণতির এক প্রতিচ্ছবি। ম্যাচ শেষে অধিনায়ক জাকের আলি বলেন, “সাইফ আজ সত্যিকারের গেমচেঞ্জার। ওর ইনিংসটাই আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে।”
এই জয়ের মাধ্যমে শুধু একটি সিরিজ জয় নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটে আত্মবিশ্বাসের এক নতুন ধারা তৈরি হলো। বিশেষ করে আফগানিস্তানের মতো প্রতিপক্ষ, যাদের বিপক্ষে বাংলাদেশ বহুবার হোঁচট খেয়েছে, তাদের বিপক্ষে ৩–০ ব্যবধানে জয়—এটি নিঃসন্দেহে বিশাল মানসিক স্বস্তি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সিরিজ জয় আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে বাংলাদেশকে দারুণ আত্মবিশ্বাস এনে দেবে। তরুণ ও নতুন মুখদের নিয়ে গঠিত দলটি প্রমাণ করেছে, তারা এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লড়াই করার মতো প্রস্তুত।
বাংলাদেশের হেড কোচ ম্যাচ শেষে বলেন, “এটা শুধু জয়ের বিষয় নয়, বরং টিম ইউনিটির প্রতিফলন। সবাই নিজেদের সেরাটা দিয়েছে। আমি গর্বিত এই দলের জন্য।”
৭ বছর আগের হোয়াইটওয়াশের দুঃখ আজ পরিণত হলো আনন্দে। শারজাহর আকাশে উড়ল লাল-সবুজের পতাকা, বাজল জয়ধ্বনি। সাইফের ব্যাট, সাইফউদ্দিনের বল আর পুরো দলের ঐক্যবদ্ধ লড়াই প্রমাণ করল—বাংলাদেশ এখন প্রতিশোধ নিতে জানে, জিততে জানে, ইতিহাস গড়তেও জানে।
এই সিরিজ জয় শুধু এক দলের নয়, বরং পুরো জাতির ক্রিকেট ভালোবাসার প্রতিফলন—যেখানে প্রতিটি রান, প্রতিটি উইকেট যেন নতুন করে ঘোষণা করছে, টাইগাররা ফিরে এসেছে তাদের গর্জনে!
বাংলাবার্তা/এমএইচ