
ছবি: সংগৃহীত
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে নিরাপত্তা বাহিনীকে শুধু গুলি চালানো নয়, বরং ড্রোনের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলা, আকাশপথে ছত্রীসেনা নামানো, নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং ইন্টারনেট ও গণমাধ্যম বন্ধ করার মতো নির্দেশ দিয়েছিলেন—এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ শোনানো ফোনালাপ থেকে।
ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত এই ফোনালাপে আরও শোনা যায়, শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ আখ্যা দিয়ে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্দোলনকে ‘জঙ্গি হামলা’ হিসেবে প্রচার করার কৌশল নিয়েও আলোচনা করেছিলেন।
বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলার ৫৩তম সাক্ষী হিসেবে দাঁড়ান প্রসিকিউটর ও বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। তিনি আদালতে শেখ হাসিনার বিভিন্ন সময়ের ফোনালাপ রেকর্ড দাখিল করেন।
জোহা তাঁর সাক্ষ্যে জানান, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর এনটিএমসির সহকারী প্রকৌশলী সাদি মোহাম্মদ রিফাতের কাছ থেকে শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং সংশ্লিষ্ট তিনটি মোবাইল নম্বরের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) জব্দ করা হয়। এসব রেকর্ড পর্যালোচনা ও ফরেনসিক পরীক্ষার পর প্রমাণ মেলে যে, ফোনালাপগুলো শেখ হাসিনা এবং অন্তত তিনজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর মধ্যে হয়েছিল।
চারটি বিশেষ ফোনালাপ আদালতে বাজানো হয়। এর মধ্যে একটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে, একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে এবং দুটি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে।
১৪ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন আদালতে বাজানো হয়। এতে মাকসুদ কামাল উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, ছাত্ররা ক্যাম্পাসে আন্দোলন জোরদার করছে এবং তাঁর বাসভবনেও হামলা হতে পারে।
জবাবে শেখ হাসিনা তাঁকে আশ্বস্ত করেন এবং বলেন: “লাঠিসোঁটা দিয়ে হবে না। পুলিশ, বিজিবি অ্যালার্ট আছে। এরা রাজাকার হইতে চাইছে। রাজাকারদের তো ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও তাই করব। একটাকেও ছাড়ব না।”
এই রেকর্ডে শেখ হাসিনাকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির তুলনা করতে এবং কঠোর দমনপীড়নের নির্দেশ দিতে শোনা যায়।
অন্য এক ফোনালাপে শেখ ফজলে নূর তাপস আন্দোলনকারীদের সচিবালয় আক্রমণের বিষয়টি শেখ হাসিনাকে জানান। এসময় শেখ হাসিনা বলেন, সেনাবাহিনী প্রস্তুত রয়েছে। তারপর তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দেন:
“ড্রোন দিয়ে ছবি নিচ্ছি। হেলিকপ্টারে অ্যাকশন হচ্ছে কয়েক জায়গায়। রাতে সবাইকে ধইরা ফেলতে বলা হয়েছে। লেথাল উয়েপন ব্যবহার করবে।”
এই কথোপকথনে শেখ হাসিনার কণ্ঠে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নিপীড়নের কঠোর সিদ্ধান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৯ জুলাই কারফিউ জারির পর শেখ হাসিনা ও হাসানুল হক ইনুর মধ্যে দুটি ফোনালাপ হয়। ইনু কারফিউ কঠোর করার পরামর্শ দেন এবং আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করে দমন করার পরিকল্পনা দেন। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন: “আকাশ থেকে নামবে, দুই পাশ দিয়ে ধরবে। আর হেলিকপ্টার দিয়ে সোজা বোম্বিং করা হবে। র্যাব হেলিকপ্টার দিয়ে ওপর দিয়ে মারবে।”
একই ফোনালাপে শেখ হাসিনা আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে এটা জঙ্গি হামলা। আমরা সেই কার্ড খেলব।”
এর মাধ্যমে বোঝা যায়, সরকার পরিকল্পিতভাবে ছাত্র আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল।
ফোনালাপগুলোতে দেখা যায়, আন্দোলন দমন করতে শেখ হাসিনা শুধু নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার, বিটিভি ও অন্যান্য স্থাপনায় আগুন লাগিয়ে দায় আন্দোলনকারীদের ঘাড়ে চাপানোর নির্দেশও দেন। ইনুকে তিনি বলেন: “সব পোড়াইয়া দিছে। ডেটা সেন্টারও পোড়াই দিছে। এখন নতুন তারতুর কিনে জোড়া লাগাতে হবে।”
ইনু পাল্টা প্রস্তাব দেন, ইন্টারনেট থাকলে সরকারপক্ষের প্রোপাগান্ডা চালানো সহজ হবে।
এই মামলায় শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে পলাতক দেখিয়ে বিচার চলছে। পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বর্তমানে কারাগারে আছেন এবং তিনি দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
আইনজীবী মহলের মতে, ফোনালাপগুলো আদালতে বাজানো হওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে গণআন্দোলন দমনের পরিকল্পনার প্রমাণ মেলে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধেরই শামিল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ