
ছবি: সংগৃহীত
ই-কমার্স খাতের বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির দুই শীর্ষ কর্ণধার মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনকে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মনিরুল ইসলামের আদালত এই রায় ঘোষণা করেন। শুধু তাই নয়, দণ্ডিত প্রত্যেককে আরও ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারক।
রায়ের ফলে একসময় অনলাইনে ব্যবসার নামে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে ভোক্তাদের প্রতারিত করা ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা দম্পতি আবারও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছেন। আদালতের এ রায়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের ন্যায়বিচারের যে দাবি ছিল, তা আংশিকভাবে পূরণ হলো বলে মন্তব্য করেছেন মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এইচ এম রুহুল আমিন মোল্লা।
ইভ্যালির বিরুদ্ধে এ মামলা করেন মো. আবুল কালাম আজাদ নামের এক গ্রাহক। তিনি ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার আদালতে প্রতারণা ও অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইভ্যালি তাদের ব্যবসার শুরু থেকেই চটকদার বিজ্ঞাপন, অবিশ্বাস্য ছাড় এবং অতি দ্রুত পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করত।
আজাদের দাবি, তিনি ইভ্যালির অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে মোট ১১টি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ২৩ লাখ টাকা প্রদান করেন। কোম্পানি তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, ৭ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তিনি পণ্য পাবেন। কিন্তু সেই সময়সীমা অতিক্রম হওয়ার পরও পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষ নানা অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করে এবং শেষ পর্যন্ত টাকা আত্মসাৎ করে।
মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত শেষে ২০২৪ সালের ১৭ মার্চ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পিবিআই। প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামিরা পরিকল্পিতভাবে প্রতারণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পরবর্তীতে ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন।
বিচার চলাকালে আদালত তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। সাক্ষ্য প্রমাণ ও নথিপত্র পর্যালোচনা করে আদালত মনে করেন, ইভ্যালির এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ভোক্তাদের প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাদের তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন।
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইভ্যালি শুরু থেকেই অবিশ্বাস্য ছাড় ও আকর্ষণীয় অফারের মাধ্যমে আলোচনায় আসে। অনলাইনে মোটরসাইকেল, গাড়ি, মোবাইল ফোনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য অর্ধেক দামে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়েই তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হাজার হাজার গ্রাহক তাদের প্ল্যাটফর্মে অর্ডার করেন। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক মডেল টেকসই নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একাধিক তদন্তে উঠে আসে, ইভ্যালি মূলত ‘পনজি স্কিম’-এর মতো কাঠামো তৈরি করে গ্রাহকের টাকা দিয়ে নতুন গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করত। গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করা, মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনের জন্য চটকদার প্রচারণা চালানো ছিল তাদের মূল কৌশল।
২০২১ সালে ব্যাপক ভোক্তা অভিযোগ এবং সরকারের হস্তক্ষেপে ইভ্যালির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠাতা রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দীর্ঘদিন তিনি কারাগারে ছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি জামিনে মুক্তি পান, কিন্তু তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা চলতে থাকে।
ইভ্যালির হাত ধরে প্রতারিত হওয়া হাজার হাজার গ্রাহক এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, এতদিনেও ন্যায়বিচার পাননি, অন্তত প্রতারণার দায়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারদের শাস্তি হওয়ায় সামান্য হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে তারা এখনও আশা করছেন, কোনো না কোনোভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেবে সরকার।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ইভ্যালির ঘটনা বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতকে এক ধাক্কায় পিছিয়ে দিয়েছে। একসময় যেভাবে এই খাত দ্রুত সম্প্রসারণ পাচ্ছিল, ইভ্যালির প্রতারণার কারণে ভোক্তাদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আরও কড়া নজরদারি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
রাসেল ও শামীমার এই দণ্ড ইভ্যালির প্রতারণার কাহিনিকে নতুন মোড় দিল। যদিও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের আর্থিক ক্ষতি পূরণ হয়নি, তবে আইনের চোখে প্রতারণার দায়ে শাস্তি পাওয়াটা একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ই-কমার্স খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং ভোক্তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই রায় ভবিষ্যতে ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ