
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে সম্পর্কিত এক ঐতিহাসিক রায়ে হাইকোর্ট ঘোষণা করেছে, এখন থেকে দেশের সব নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। একই সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনী ও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে আনা পরিবর্তনকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এই রায়ের ফলে নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত হয়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সুসংহত হবে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আরও বলা হয়, আগামী তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠন করতে হবে। এ সচিবালয় শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের অধীনে কাজ করবে এবং বিচারকদের প্রশাসনিক বিষয়গুলো পরিচালনা করবে।
বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের বৈধতা প্রশ্নে ১৩ আগস্ট চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয় এবং এদিনই রায়ের জন্য ২ সেপ্টেম্বর তারিখ ধার্য করা হয়। এর আগে ২৩ এপ্রিল থেকে মামলাটির চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। অন্যদিকে ইন্টারভেনর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম।
রিটকারী আইনজীবী শিশির মনির জানান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ১১৬ পুনর্বহালের দাবিতে তারা রিট দায়ের করেছিলেন। আদালতের এই রায়ের মাধ্যমে সেই দাবি পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হলো।
২০২৩ সালের ২৫ আগস্ট ১০ জন আইনজীবীর পক্ষে অ্যাডভোকেট শিশির মনির হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটে বলা হয়, বর্তমানে কার্যকর সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী। কারণ এখানে বলা হয়েছে— অধস্তন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে।
কিন্তু ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ছিল ভিন্ন ব্যবস্থা। সেখানে উল্লেখ ছিল— বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও বিচারিক দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকবে। পরবর্তীতে একাধিক সংশোধনের মাধ্যমে এই ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে চলে যায়, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
মামলাটি প্রথমে বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু গত ২৪ মার্চ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় বেঞ্চটি ভেঙে যায়। পরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নতুন বেঞ্চ গঠন করে দেন। সেই বেঞ্চেই আজকের এই রায় ঘোষণা করা হলো।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রায় বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন ধরে বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি বা শৃঙ্খলা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। এর ফলে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিল না। হাইকোর্টের এই রায় কার্যকর হলে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে সুপ্রিম কোর্টের অধীনেই থাকবে, যা সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
রায়ের পর অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, “এটি আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক বিশাল জয়। এখন বিচারকরা আর নির্বাহী বিভাগের অধীন নন। তারা শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের অধীন থেকে কাজ করবেন।”
রাষ্ট্রপক্ষ এখনও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সরকার রায়টি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনে আপিলে যেতে পারে।
হাইকোর্টের এই রায়ের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ঘিরে দীর্ঘদিনের বিতর্কের অবসান হলো। এখন থেকে বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলাজনিত সব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টই হবে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও শক্তিকে নতুন মাত্রা দেবে— এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট মহলের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ