
ছবি: সংগৃহীত
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নতুন করে আলোচনার ঝড় তুলেছে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের জবানবন্দি। তিনি মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-০১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এমন এক বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন, যা পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে মামুন বলেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে তৎকালীন আইজিপি (পুলিশ মহাপরিদর্শক) ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি পরামর্শ দেন ব্যালট বাক্সের অর্ধেক আগেই ভোটে পূর্ণ করে রাখতে। এই পরামর্শের উদ্দেশ্য ছিল পরদিন ভোটের দিন যেন কোনো পরিস্থিতিতেই আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ঝুঁকি না থাকে। সাবেক আইজিপির এই বক্তব্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের অভিযোগ আবারও সামনে চলে এসেছে।
জবানবন্দিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন, পুলিশের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরেই একটি “গোপালগঞ্জ সিন্ডিকেট” সক্রিয় ছিল। তারা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভ্যন্তরেই নয়, নির্বাচনী প্রস্তুতি থেকে শুরু করে আন্দোলন দমন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করতো। এই সিন্ডিকেট প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি, এমনকি গোপন অভিযানের নেতৃত্বও নিয়ন্ত্রণ করত।
মামুন ট্রাইব্যুনালে স্বীকার করেন যে ২০১৮ সালের জুলাই আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের দমন করতে মারণাস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয় রাজনৈতিক পর্যায় থেকে। তিনি বলেন, “লেথাল উইপেন ব্যবহারের নির্দেশনা এসেছিল সরাসরি শেখ হাসিনার কাছ থেকে।” সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব এবং ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে ছিলেন অতিউৎসাহী।
তার বক্তব্য অনুযায়ী, শুধু মাঠ পর্যায়ের পুলিশ নয়, রাজনৈতিকভাবে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকেই আন্দোলনকারীদের দমন, গুলি চালানো, এমনকি হেলিকপ্টার থেকে অস্ত্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের নামে এ ধরনের সামরিক ধাঁচের অভিযানের মাধ্যমে বহু সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান এবং শত শত মানুষ আহত হন।
চাঞ্চল্যকরভাবে মামুন আরও জানান, র্যাব-১ ইউনিটে টিআইএফ নামে একটি গোপন বন্দিশালা পরিচালিত হতো। শুধু র্যাব-১ নয়, দেশের অন্যান্য র্যাব ইউনিটেও একই ধরণের গোপন বন্দিশালা ছিল, যেখানে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের সমালোচক বা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের তুলে এনে রাখা হতো। এসব বন্দিশালায় নির্যাতন চালানো হতো, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো এবং অনেক ক্ষেত্রে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হতো না।
তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আয়নাঘরে আটক ও ক্রসফায়ারে হত্যার মতো কাজগুলো করতেন র্যাবের এডিসি অপারেশন ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক।” আর এসব নির্দেশনা আসত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। অনেক সময় সরাসরি নির্দেশ দিতেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, তিনি স্বেচ্ছায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়েছেন। এর আগে চলতি বছরের ২৪ মার্চ মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার ভাষায়, “আমি সত্য গোপন করতে চাই না। আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে আমি সত্য উন্মোচন করতে চাই।”
উল্লেখ্য, জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবার, চিকিৎসকসহ ইতোমধ্যেই ৩৫ জন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে। প্রসিকিউশনের প্রত্যাশা, চলতি মাসেই এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হবে।
সাবেক আইজিপি মামুনের এই জবানবন্দি একদিকে যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলছে, অন্যদিকে আন্দোলন দমন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও প্রকাশ করছে ভিন্ন মাত্রায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা ছাড়া নির্বাচনের আগের রাতে ভোট বাক্স ভরার মতো সিদ্ধান্ত কিংবা আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মতো পদক্ষেপ সম্ভব ছিল না। এখন দেখা যাক, ট্রাইব্যুনালের এই মামলায় শেষ পর্যন্ত কী রায় আসে এবং রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে কী সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ