
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণা, ভুয়া তথ্য প্রচার ও ভোক্তা হয়রানি রোধে সরকার গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে “ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ” প্রণয়ন করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। খসড়া অনুযায়ী, অনলাইনে ভুয়া বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে পণ্য বিক্রি করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড, অনাদায়ে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে পণ্য বা সেবা সরবরাহ না করলে মূল্যের কয়েক গুণ জরিমানা দিতে হবে বিক্রেতাকে। নিষিদ্ধ বা ক্ষতিকর পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও থাকছে বড় অঙ্কের জরিমানার বিধান।
ই-কমার্স খাতের দ্রুত বিকাশের সাথে সাথে নানা অনিয়ম, প্রতারণা, ভুয়া বিজ্ঞাপন, দেরিতে ডেলিভারি, কিংবা পণ্য সরবরাহ না করে গ্রাহকের টাকা আটকে রাখার মতো ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২০-২১ সালে একাধিক বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে অস্বচ্ছ লেনদেন ও কোটি কোটি টাকা আটকে যাওয়ার ঘটনায় ভোক্তাদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। তখন থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে খাতটিকে শৃঙ্খলিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ২০২৪ সালের মে মাসে তৎকালীন মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সংক্রান্ত একটি খসড়া অনুমোদন হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেটি আর অগ্রসর হয়নি। এবার অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে খসড়া তৈরি করেছে। শিগগিরই এটি অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উত্থাপন করা হবে।
অধ্যাদেশের খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ডিজিটাল বাণিজ্য’ বলতে বোঝানো হবে যেকোনো ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইনে পণ্য ও সেবা কেনাবেচা। প্রতিটি পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য, মূল্য, ডেলিভারি সময়, অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
এ ছাড়া, ভুয়া বা অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করলে কঠোর শাস্তি হবে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, আমদানি নিষিদ্ধ কিংবা ওষুধের মোড়কে সঠিক তথ্য ছাড়া কোনো পণ্য অনলাইনে বিক্রি করা যাবে না। অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল গিফট কার্ড, ওয়ালেট, ক্যাশ ভাউচার চালু করলে জরিমানা হবে। অনলাইনে লটারির আয়োজন করলেও গুনতে হবে বড় অঙ্কের জরিমানা।
খসড়া অনুযায়ী, দেশে যেকোনো ই-কমার্স বা ডিজিটাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। নিবন্ধন ছাড়া ব্যবসা করলে শাস্তি হবে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে একটি ডিজিটাল বিজনেস আইডেনটিটি (ডিবিআইডি) প্রদান করা হবে। তবে যদি প্রতারণামূলক কার্যক্রম চালায়, তবে নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হবে।
অধ্যাদেশ পাশ হলে প্রতিষ্ঠিত হবে “ডিজিটাল বাণিজ্য কর্তৃপক্ষ”। এটি হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দেবেন একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং তাকে সহায়তা করবেন চারজন সদস্য।
পাশাপাশি একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হবে, যেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী, বাণিজ্য উপদেষ্টা বা প্রতিমন্ত্রী থাকবেন প্রধান হিসেবে। এর উদ্দেশ্য হবে নীতি নির্ধারণে গতিশীলতা আনা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্বগুলো হবে— ডিজিটাল বাণিজ্যের প্রসার ও শৃঙ্খলা রক্ষা। ভোক্তা অভিযোগ গ্রহণ ও সমাধান। প্রতারণা প্রতিরোধ ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনিয়ম হচ্ছে কি না তা তদারকি করা। দেশি উদ্যোক্তাদের বাজার সম্প্রসারণ ও রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়তা। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় তদন্ত পরিচালনা।
তবে সব অনলাইন কার্যক্রম এই আইনের আওতায় আসবে না। খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে— অনলাইন ব্যাংকিং বা আর্থিক সেবা, মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কার্যক্রম, অনলাইন জুয়া বা লটারি, যৌন উত্তেজক দ্রব্য বা কনটেন্ট বিক্রি ও প্রদর্শন, এসকর্ট সেবা ইত্যাদি এই আইনের বাইরে থাকবে।
কর্তৃপক্ষ সরকারি তহবিল থেকে অর্থায়ন করবে। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশি সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা কিংবা উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকেও অনুদান, ঋণ বা প্রকল্প সহায়তা নেওয়া যাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, এই অধ্যাদেশের মূল উদ্দেশ্য হলো ভোক্তার অধিকার সুরক্ষা, ই-কমার্স খাতকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা, উদ্যোক্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ