
ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে মেজর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল—বিএনপি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই পথচলা এখন ৪৭ বছরে পা দিয়েছে। চার দশকের বেশি সময় ধরে দলটি দেশের রাজনীতিতে কখনো ক্ষমতায়, কখনো বিরোধী দলে, আবার কখনো রাস্তায় আন্দোলনে—উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে টিকে আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজ বিএনপির সামনে প্রশ্ন—চ্যালেঞ্জগুলো কী, আর কোন পথে এগোবে দলটি?
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে বিদ্রোহ করে বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। স্বাধীন, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল তার। তবে ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক বিপর্যয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং বাকশালের একদলীয় শাসনের পর দেশে তৈরি হয় বড় শূন্যতা। সেই শূন্যতায় নেতৃত্বের আসনে আসেন জিয়াউর রহমান।
প্রথমে তিনি ‘জাগো দল’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলেন। পরে তা রূপ নেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি)। বহুদলীয় রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দলটি।
দেশ তখন বাকশালের একক কর্তৃত্বের ছায়ায় আবদ্ধ ছিল। বিএনপির জন্ম দেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। বহুদলীয় রাজনীতির দরজা খুলে দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক শক্তির এক নতুন প্রতীক। এরপর প্রায় পাঁচ দশকে দলটি কখনো ক্ষমতায় থেকেছে, কখনো বিরোধী দলে থেকেছে, আবার কখনো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছে। বলা হয়, সংকট থেকে বারবার ফিনিক্স পাখির মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিএনপি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতে, বিএনপি প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তার ভাষায়, “শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা, শেখ মুজিবের চলে যাওয়া—সব মিলিয়ে তখন রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে মধ্যপন্থি শক্তিশালী একটি দল প্রয়োজন ছিল। বিএনপি সেই দায়িত্ব নিয়েছিল। না হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো।”
বিএনপি কখনো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, কখনো নির্বাচনের মাঠে লড়েছে, কখনো সরকার পরিচালনা করেছে। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করে দলটি নতুন ইতিহাস তৈরি করেছিল। আবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সক্রিয় ছিল। তবে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আন্দোলন, মামলা ও নেতৃত্ব সংকটও দলটিকে অনেক সময় দুর্বল করেছে।
তারপরও দলটি বলছে—বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন থেকেই তারা পথ চলবে, কোনো নীতি পরিবর্তন হবে না।
প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, “গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা বেরিয়ে এসেছে। সেই বাস্তবতা মোকাবিলা করে আমাদের রাজনীতি চালাতে হবে। শিল্প, কৃষি, সেবা খাত, কর্মসংস্থান—এসব খাতে নতুন চ্যালেঞ্জ আছে। এর সমাধানে উদ্ভাবনী বিনিয়োগনীতি গ্রহণ করতে হবে। বিএনপি ইতিমধ্যেই এসব বিষয় চিহ্নিত করেছে এবং কাজও শুরু করেছে।”
১৯৭৮ সালের সূচনালগ্ন থেকে বিএনপির রাজনীতি নানা উত্থান-পতন, জয়-পরাজয় আর বিতর্কে ভরা। প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে এসে দলটির সামনে একদিকে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে জনগণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করার প্রশ্ন। ইতিহাসের নানা ক্রান্তিলগ্নে নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি। কিন্তু এখন সময়—ভবিষ্যতের জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যকর কৌশল বাস্তবায়নের। দলের নেতারা বলছেন, জাতীয়তাবাদের চেতনাকে ধারণ করে তারা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
বাংলাবার্তা/এমএইচ