
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আবারও উচ্চসুদে (অনমনীয় শর্তে) বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটছে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ব্যাংক খাত সংস্কারসহ সার, জ্বালানি আমদানি, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় করার জন্য প্রায় ১৮৬ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় পৌনে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়া হচ্ছে। দেশি মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে হিসাব)।
এ ঋণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চীনের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) থেকে প্রথমবারের মতো নেওয়া ৩২ কোটি ডলার। বাকি অর্থ আসছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি), অপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ওএফআইডি) এবং অন্যান্য দাতা সংস্থা থেকে।
সম্প্রতি সরকারের ৩৯তম অনমনীয় ঋণ সংক্রান্ত বৈঠক (এসসিএনসিএল) অনুষ্ঠিত হয় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে। সেখানে বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারে প্রকল্পসমূহ নির্ধারিত মেয়াদে শেষ করার ওপর জোর দেওয়া হয়। একইসঙ্গে নিয়মিত মনিটরিংয়ের নির্দেশ দেন অর্থ উপদেষ্টা।
তিনি বৈঠকে উল্লেখ করেন, বৈশ্বিক বাজারে ধীরে ধীরে সুদের হার কমছে এবং আগামীতে আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে। ঋণ গ্রহণে এই দিকটিও বিবেচনায় নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দাতাদের কাছ থেকে দুই ধরনের ঋণ পেয়ে আসছে—
-
নমনীয় বা স্বল্পসুদের ঋণ
-
অনমনীয় বা উচ্চসুদের ঋণ
তবে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির কারণে নমনীয় ঋণের প্রবাহ কমছে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে অনমনীয় ঋণের ওপর। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ প্রবণতা ঋণসেবা ব্যয় বাড়াচ্ছে এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকী অবশ্য বলছেন, “এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে নমনীয় ঋণ বন্ধ হয়নি। দুই ধরনের ঋণই পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রকল্পভেদে কখনো কখনো অনমনীয় ঋণ নিতে হয়।”
সূত্র জানায়, ১৮৬ কোটি ডলারের উচ্চসুদের ঋণ নিম্নোক্ত খাতে ব্যয় হবে:
-
এডিবি থেকে ১৪০ কোটি ৪০ লাখ ডলার
-
ব্যাংক খাত সংস্কারে ৫০ কোটি ডলার (সুদহার ৪.৮২%, ১২ বছরে পরিশোধযোগ্য, প্রথম ৩ বছর গ্রেস)।
-
সার আমদানিতে ৫০ কোটি ডলার।
-
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের সরবরাহ ব্যবস্থা টেকসইকরণে ২০ কোটি ডলার (সুদহার ৪.৯৩%, ২৫ বছরে পরিশোধ, ২ বছর গ্রেস)।
-
ঢাকা-নর্থ করিডর রোড প্রকল্পে ২০ কোটি ৪০ লাখ ডলার (সুদহার ৪.৮৩%, ২৫ বছরে পরিশোধ, ৫ বছর গ্রেস)।
-
-
আইটিএফসি থেকে ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার
-
জ্বালানি তেল আমদানির জন্য।
-
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সার আমদানির জন্য অতিরিক্ত ৫০ কোটি ডলার (সুদহার প্রায় ৬%)।
-
-
এনডিবি থেকে ৩২ কোটি ডলার
-
ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নে (সুদহার ৩.৩৬%, মেয়াদ ৩০ বছর)।
-
এ প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা শোধনাগার থেকে ৪০ কিলোমিটার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরি হবে। এতে ঢাকা উত্তর-পশ্চিমের প্রায় ৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
-
-
ওএফআইডি থেকে ১১ কোটি ২৪ লাখ ডলার
-
চলতি অর্থবছরের বাজেট সহায়তা হিসেবে।
-
-
বিপিসি ও পেট্রোবাংলার জন্য
-
তেল ও তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য যথাক্রমে ১৬ কোটি ৫০ লাখ ও ৬০ কোটি ডলার ঋণ। সুদের হার প্রায় ৬%।
-
এডিবির ৫০ কোটি ডলার ঋণ বিশেষভাবে আলোচিত, কারণ এটি ব্যয় হবে ব্যাংক খাত সংস্কারে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, ঋণ লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে ভেঙে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি বড় সংস্কার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এডিবির ঋণ সেই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহার হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক খাত পুনর্গঠন ছাড়া অর্থনীতির ওপর চাপ কমবে না। তবে ঋণের শর্ত ও সুদের হারও দেশের ভবিষ্যৎ আর্থিক ভারসাম্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বৈঠকে বলেন, আইটিএফসি থেকে নেওয়া সার আমদানির ঋণ অনুমোদিত হলে এলসি খোলার অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। এতে দেশের সার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ টেকসইকরণ প্রকল্পে নেওয়া ২০ কোটি ডলার দিয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ গ্রিডের দক্ষতা ও জলবায়ু সহনশীলতা বাড়ানো হবে। ২০৩০ সালের জুনে এ প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা।
ঢাকা-নর্থ করিডর রোড প্রকল্পে প্রাপ্ত ঋণ দিয়ে সড়ক অবকাঠামো আধুনিকীকরণ করা হবে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ, বাজেট ঘাটতি ও এলডিসি উত্তরণের প্রেক্ষাপটে সরকার ধারাবাহিকভাবে উচ্চসুদের ঋণের দিকে ঝুঁকছে। এতে একদিকে তাৎক্ষণিক প্রকল্প বাস্তবায়ন ও আমদানির খরচ মেটানো সম্ভব হলেও অন্যদিকে ঋণসেবা ব্যয় দ্রুত বাড়ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এ নীতিতে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়তে পারে। সরকার বলছে—প্রকল্প বাস্তবায়ন ও খাতভিত্তিক সংস্কারেই এ ঋণ টেকসই উন্নয়নে কাজে লাগবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ