
ছবি: সংগৃহীত
রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠককে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিক্রিয়া জানান।
নাভারো বলেন, “মোদিকে শি জিনপিং ও পুতিনের সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা সত্যিই লজ্জার। আমি বুঝতে পারছি না তিনি কী ভাবছেন। আমরা আশা করি, তিনি বুঝবেন যে তাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে, রাশিয়ার সঙ্গে নয়।” যুক্তরাষ্ট্রের এ মন্তব্য মোদির এসসিও সম্মেলনে যোগদান এবং চীন সফর শেষ করার মাত্র একদিন পরেই এসেছে। ফলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, ওয়াশিংটন ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে প্রবলভাবে অসন্তুষ্ট।
এর আগে পিটার নাভারো ভারতকে ‘শুল্কের মহারাজা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তার দাবি, বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান খেলোয়াড়দের মধ্যে ভারতই সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ করে। অথচ নয়াদিল্লি এই বাস্তবতাকে স্বীকার করতেও নারাজ। তিনি আরও বলেন, “ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যাটা দ্বিমুখী। প্রথমত, ২৫ শতাংশ প্রতিশোধমূলক শুল্ক—যেটি অন্যায্য বাণিজ্যনীতির প্রতিফলন। দ্বিতীয়ত, আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আমরা বসিয়েছি কারণ ভারত রাশিয়া থেকে তেল কিনছে।”
শুধু শুল্ক নিয়েই নয়, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের জ্বালানি বাণিজ্যকেও যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনার কেন্দ্রে রেখেছে। নাভারো অভিযোগ করেন, ভারতীয় রিফাইনারিগুলো রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল সস্তায় কিনে এনে দেশে প্রক্রিয়াজাত করছে এবং পরে তা প্রিমিয়াম দামে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করছে। এ কারণেই তিনি ভারতকে ‘ক্রেমলিনের লন্ড্রোম্যাট’ আখ্যা দেন। তার ভাষায়, “ভারত যেন রাশিয়ার হয়ে বিশ্ববাজারে তেলের ব্যবসা করছে, যা রাশিয়ার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে।”
নাভারো আরও বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের রপ্তানির ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করেছে এবং তা পুরোপুরি ন্যায্য। কারণ নয়াদিল্লির রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করছে।” তিনি সতর্ক করে দেন যে ভারত যদি কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যায়, তবে এর পরিণতি দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য সুখকর হবে না
অন্যদিকে ভারত তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। নয়াদিল্লি জানিয়েছে, রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা একান্ত প্রয়োজনীয়—কারণ এর মাধ্যমে জ্বালানির খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং ঘরোয়া বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। ভারত মনে করে, এটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, ভূ-রাজনৈতিক কোনো জোটবদ্ধতার অংশ নয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলোকে ‘অন্যায্য’ বলেও অভিহিত করেছে।
ভারত আরও অভিযোগ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র যেসব ‘সেকেন্ডারি ট্যারিফ’ চাপিয়েছে, তার প্রধান শিকার এখন পর্যন্ত ভারতই। অথচ চীনও রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে একই মাত্রার পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এখন প্রশ্ন উঠছে, ভারত আসলে কাকে প্রাধান্য দিচ্ছে—যুক্তরাষ্ট্রকে নাকি রাশিয়া-চীন জোটকে। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই চাইছে ভারত যেন ওয়াশিংটন-নেতৃত্বাধীন কৌশলগত জোটে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায়। কিন্তু ভারত বরাবরই তার ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’ নীতির কথা বলে এসেছে এবং রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি সহযোগিতা বজায় রেখেছে।
অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়ানো মোদির ছবি শুধু মার্কিন প্রশাসনকেই নয়, ইউরোপীয় কয়েকটি দেশকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বৈশ্বিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত হয়তো বহুমাত্রিক কূটনীতি চালিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু এই অবস্থান তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে ঠেলে দিচ্ছে।
পুতিন ও শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদির হাসিমুখে বৈঠক কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচারই ছিল, নাকি এর আড়ালে গভীর রাজনৈতিক বার্তা আছে—এখন সেটাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভারতের এই অবস্থান মেনে নিতে তারা প্রস্তুত নয়। তবে ভারত তার জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কেনা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্ব কূটনৈতিক সমঝোতায় মিটবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কের নতুন টানাপোড়েন তৈরি করবে, তা এখন সময়ই বলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ