
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) ব্যয় এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের সব ব্যাংক মিলে সিএসআর খাতে ব্যয় করেছে মাত্র ১৫০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এর আগের ছয় মাসে এই ব্যয় ছিল ৩০৭ কোটি টাকা। অর্ধেকেরও বেশি কমে যাওয়া এই ব্যয় ব্যাংক খাতের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও এর ব্যবহার নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
দশ বছরের তুলনা
গত দশকে এত কম সিএসআর ব্যয় হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় ছিল ২৫৪ কোটি টাকা। এই তুলনায় ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০৪ কোটি কম। ব্যাংকের ব্যয় তালিকায় এটি নতুন একটি নিম্নমুখী ধারা নির্দেশ করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বরে সিএসআরে ব্যয় ছিল প্রায় ২৯৮ কোটি টাকা। ২০২২ সালের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি টাকায়। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যয় হয় ৩০৯ কোটি, দ্বিতীয় ছয় মাসে ৩৫৩ কোটি এবং শেষ ছয় মাসে ৩০৭ কোটি টাকায়। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫০ কোটি টাকায়।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব
সিএসআরের ব্যয়ে এত বড় পতনের পেছনে ব্যাংকাররা রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন। একজন বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আগে অনেক সময় সিএসআর বাজেট ব্যবহার হতো রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছা অনুযায়ী। এখন সেই চাপ নেই। ব্যাংক নিজের বিবেচনায় খরচ করছে, তাই ব্যয়ও কমে গেছে।”
রাজনৈতিক সরকারের সময়ে ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করতে হতো—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অনুষ্ঠান বা অনুদান। রাজনৈতিক ও স্থানীয় নেতাদের অনুরোধে এমন ব্যয় প্রায় বাধ্যতামূলক হতো। সরকারের পরিবর্তনের পর সেই চাপ অনেকটাই কমেছে।
সিএসআর খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সিএসআর ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জরুরি। রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেক সময় এই অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যায়। ড. ফারুক হাসান বলেন, “প্রতিবছর সিএসআর অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ সঠিক উদ্দেশ্যে ব্যয় হয় না। স্বচ্ছতা না থাকায় ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা ব্যাহত হচ্ছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে বছরে নিট মুনাফার একটি অংশ সিএসআর খাতে ব্যয় করতে হবে। তবে বাস্তবে কোথায়, কীভাবে খরচ হলো—এই বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য বা জবাবদিহিতা নেই।
ব্যয়ের খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় সিএসআর ব্যয়ের বণ্টন নির্ধারিত আছে:
-
শিক্ষা খাত: ৩০%
-
স্বাস্থ্য খাত: ৩০%
-
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায়: ২০%
-
বাকি ২০%: আয় উপযোগী উদ্যোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, খেলাধুলা, বিনোদন ও অন্যান্য
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক নির্দেশনা উপেক্ষা করে সবচেয়ে বেশি অর্থ ‘অন্যান্য’ খাতে ব্যয় করেছে—৮৩ কোটি টাকা বা ৫৫%। শিক্ষায় ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা (২২.৭৫%), স্বাস্থ্য খাতে ২৮ কোটি ১২ লাখ টাকা (১৮.৬৭%), এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মাত্র ৫ কোটি ২১ লাখ টাকা (৩.৪৬%)।
কোন ব্যাংকগুলো খরচ করেনি
১৩টি ব্যাংক সিএসআরে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি। এদের মধ্যে রয়েছে: জনতা ব্যাংক, অগ্রণী, বেসিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স, ন্যাশনাল, পদ্মা ব্যাংক, কমিউনিটি, এসবিএসসি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সিএসআর ব্যয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা সতর্কবার্তা। ড. নাসরুল ইসলাম বলেন, “সামাজিক দায়বদ্ধতা শুধু একটি আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, এটি ব্যাংকের ভাবমূর্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট কম ব্যয় করলে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠানিক বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হয়।”
অর্থনীতিবিদ ড. লিয়াকত আলী বলেন, “সিএসআর অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্বচ্ছতা ও নিয়মিত তদারকি জরুরি। না হলে এই অর্থ শুধু হিসাবের জন্য থাকে, প্রকৃত সামাজিক উন্নয়নে কোনো প্রভাব ফেলে না।”
বিশেষজ্ঞরা একমত, ব্যাংকগুলো যদি রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে সিএসআর অর্থকে সামাজিকভাবে উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না করে, তবে এটি শুধু ব্যয়ের হিসাবের খাতা কমিয়ে আনার সূচক নয়, বরং দেশের সামাজিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ