
ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে মাদক সমস্যার ভয়াবহতা দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। ইয়াবার পর নতুন নতুন মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে ঢুকছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) জানিয়েছে, দেশের মাদক ব্যবসায় মাফিয়ারা এখন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে এবং তরুণ সমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করছে। এতে উদ্বেগ বাড়ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায়।
ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলের বাইরে সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে এমডিএমএ বা মেথালাইন ডি-অক্সি মেথ-অ্যাম্ফিটামিন। ইউরোপ ও আমেরিকায় বহুল ব্যবহৃত এই মারাত্মক মাদক এখন বাংলাদেশেও বাজার তৈরি করছে। সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর এই নতুন মাদকের চালান ধরা পড়ে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩১৭টি এমডিএমএ বড়ি, গাঁজা এবং কিটামিন।
ডিএনসির মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ জানিয়েছেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার আড়ালে সংঘবদ্ধ মাদকচক্রের অংশ ছিল। তারা ঢাকার অভিজাত এলাকায় ডিজে পার্টি ও ক্লাবগুলোতে এসব মাদক সরবরাহ করত।
ডিএনসির হাতে রয়েছে ৮৫ জন গডফাদারসহ এক হাজার ২৩০ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা। তবে শীর্ষ মাদক গডফাদাররা এখনও অধরা রয়ে গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালিকা হালনাগাদ করার নির্দেশ দিলেও তা এখনো করা হয়নি।
সামাজিক বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গডফাদারদের গ্রেপ্তার না করতে পারলে কেবল খুচরা ব্যবসায়ীদের ধরে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌফিক আলম বলেন, “সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো— মাদকচক্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করছে। এর ফলে মেধাবী তরুণরা ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে এবং সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়াচ্ছে।”
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানসের প্রধান ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেছেন, “বর্তমানে দেশে প্রায় দেড় কোটি মাদকসেবী রয়েছে। তরুণরা আড্ডার নাম করে মাদককে সামাজিক যোগাযোগের উপকরণ বানিয়ে ফেলছে। এই ধারা বন্ধ না হলে আগামী প্রজন্ম ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়বে।”
ডিএনসির তথ্যমতে, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এখন মাদক কেনাবেচার নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ফেসবুক, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মাদক অর্ডার করা যাচ্ছে, যা পরে কুরিয়ার সার্ভিসে সরবরাহ করা হয়।
সম্প্রতি টঙ্গীর একটি কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে তোয়ালের ভেতরে লুকানো ৬.৪৪ কেজি কিটামিন উদ্ধার করে ডিএনসি। এতে আন্তর্জাতিক চক্রের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশকে শুধু ভোক্তা নয়, বরং ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার করছে। প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ ইয়াবা দেশে ঢুকছে, যার একটি অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে, আরেকটি অংশ অন্যান্য দেশে পাচার করা হচ্ছে।”
বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে দিনে গড়ে প্রায় ৫৫ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট সীমান্তপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। একইসঙ্গে কোকেন, হেরোইন, আইস, কিটামিনসহ নানা ধরনের মাদক প্রবেশ করছে।
ডিএনসির মহাপরিচালক হাসান মারুফ বলেন, “চক্রগুলো দীর্ঘদিন ধরেই কুরিয়ার সার্ভিস ও আন্তর্জাতিক ডাকযোগ ব্যবহার করছে। সীমান্ত থেকে শুরু করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা পর্যন্ত মাদকের ছড়াছড়ি।”
মাদক টাকার ভাগাভাগি নিয়ে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। রাজধানীর কালশী এলাকায় সম্প্রতি বোনকে ছুরি মেরে ভাইকে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে, যাদের দুজনই মাদকচক্রের সঙ্গে যুক্ত। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় নারী-শিশুসহ ৯ জন হত্যার পেছনেও ছিল মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্ব।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “মাদক এখন দেশের বড় সামাজিক সমস্যা। সীমান্ত দিয়ে মাদক ঢুকছে এবং প্রতিদিনই নতুন কারবারি ধরা পড়ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মাদকের প্রবাহ আরও বাড়ছে।”
অর্থনীতিবিদ ড. ফারুক হাসান মনে করেন, “প্রতিবছর মাদকের কারণে দেশ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হচ্ছে। এই অর্থনীতির ধ্বংসাত্মক প্রভাব জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়ছে।”
সমাজবিজ্ঞানী ড. শাহনাজ পারভীন বলেন, “মাদক শুধু একটি অপরাধ নয়, এটি এখন একটি সামাজিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে। পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে, অপরাধ বাড়ছে, তরুণ সমাজ ধ্বংস হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও জরুরি।”
বিশেষজ্ঞরা একমত যে, শীর্ষ গডফাদারদের গ্রেপ্তার না করলে মাদক দমন সম্ভব নয়। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের পুনর্বাসন, পরিবারভিত্তিক নজরদারি এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করতে হবে। না হলে মাদক সমস্যাই হবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সবচেয়ে বড় হুমকি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ