
ছবি: সংগৃহীত
নেপাল আজ এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। জেন-জি প্রজন্মের তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনের জোয়ার দেশটির পুরোনো ক্ষমতার সমীকরণ ভেঙে দিয়েছে। দীর্ঘ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার পর সুশীলা কার্কির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি হিসেবে পরিচিত কার্কি এখন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী। তার নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি মন্ত্রিসভাও গঠিত হয়েছে। এতে অর্থমন্ত্রী হয়েছেন সাবেক আমলা রমেশ্বর খানাল, জ্বালানিমন্ত্রী হয়েছেন বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের জন্য জনপ্রিয় কুলমান ঘিসিং এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন অভিজ্ঞ প্রশাসক ওম প্রকাশ আরিয়াল। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি এখনও শূন্য। সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, একাধিক সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনা চলছে, তবে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।
যিনিই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিন না কেন, তাকে সামলাতে হবে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। সামনের মার্চে নির্ধারিত নির্বাচনের আয়োজন, বিক্ষোভে ধ্বংস হওয়া শত শত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, এবং রাজনৈতিক আস্থা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নতুন সরকারকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রতিবেশী ভারত ও চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সমর্থন অত্যন্ত জরুরি।
নতুন সরকারকে একদিকে বৈদেশিক সহায়তা সংগ্রহ করতে হবে, অন্যদিকে তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ভারত ও চীনের বিপরীত অবস্থান, সঙ্গে মার্কিন কৌশলগত উপস্থিতি নেপালকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর নেপাল অ্যান্ড সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক মৃগেন্দ্র বাহাদুর কার্কি বলেছেন, নতুন প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে দালাই লামাসহ বিভিন্ন পক্ষের বার্তা জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। “এই ভূ-রাজনৈতিক অস্পষ্টতা দূর করাই হবে সরকারের বড় পরীক্ষা,” মন্তব্য করেন তিনি।
দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সাবেক উপদেষ্টা শঙ্কর দাস বৈরাগী বলেন, বিদেশ নীতি পরিচালনায় নেপালের ব্যর্থতা এখনকার সংকটের বড় কারণ। “আমরা বহিরাগত শক্তি ও বন্ধুদের আচরণ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের নীতি এখন অন্যদের মনোভাব দ্বারা নির্ধারিত হচ্ছে। এটি একজন পাইলটের ভুল সিদ্ধান্তের মতোই বিপজ্জনক।”
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলির সময়কালের ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপগুলোও আজকের জটিলতার জন্য দায়ী। উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে—চীনে সামরিক কুচকাওয়াজে ওলির উপস্থিতি। জাপানের সঙ্গে নেপালের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন অংশীদারিত্ব থাকা সত্ত্বেও এই পদক্ষেপটিকে অযৌক্তিক বলেই মনে করা হচ্ছে।
অর্থনীতির ওপরও বিশাল চাপ তৈরি হয়েছে। করোনা মহামারির পর নেপালের পর্যটন খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও সাম্প্রতিক বিক্ষোভে আস্থা অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। কাঠমান্ডু-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক নিশ্চল এন পান্ডে বলেন, “নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যটনের মৌসুম। আমাদের দ্রুত আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, যাতে বিদেশিরা আবারও নেপালকে নিরাপদ মনে করে আসতে পারেন।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিডি ভাট্টার মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন না করলে পুনর্গঠন সম্ভব নয়। তার ভাষ্য, “এই সরকার আন্দোলন থেকে এসেছে। তাই প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা ছাড়া উপায় নেই। বাহ্যিক চাপ সামলানো পুরোপুরি নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্থিতিশীলতার ওপর।”
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই আন্তর্জাতিক মহল থেকে সমর্থন ও শুভেচ্ছা এসেছে। কিন্তু একই সঙ্গে অতীতের ভুলের স্মৃতিও তুলে ধরা হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, নেপাল যদি এবারও সঠিক কৌশল নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী কার্কি এখন একদিকে দেশের ভেতর জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে বিদেশি সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য—এই তিনটি ক্ষেত্রেই তার সরকারকে সফল হতে হবে। নতুবা জেন-জি আন্দোলনের যে স্বপ্নে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আবারও হতাশায় রূপ নিতে পারে।
নেপাল এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। অন্তর্বর্তী সরকার কি সত্যিই দেশকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, নাকি অস্থিরতার অতল গহ্বরে ঠেলে দেবে—এখন সেটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সুশীলা কার্কির সরকারকে তাই শুধু প্রশাসনিক দক্ষতাই নয়, কৌশলগত প্রজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতাও প্রদর্শন করতে হবে। সময়ই বলে দেবে, নেপাল এই সঙ্কটকাল অতিক্রম করে নতুন এক রাজনৈতিক দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে কি না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ