
ছবি: সংগৃহীত
গাজার ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসরাইল জাতিগত নিধন বা জেনোসাইড চালাচ্ছে— জাতিসংঘের স্বাধীন অনুসন্ধান কমিশনের দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনই বিস্ফোরক সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এই প্রথম প্রকাশ্যে জানানো হলো। মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত ৭২ পাতার এই তদন্ত প্রতিবেদনকে আন্তর্জাতিক মহল ‘এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের সবচেয়ে প্রামাণ্য ফলাফল’ বলে উল্লেখ করেছে। এতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ইসরাইল রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নিজেরাই এই জাতিগত নিধনকে উসকে দিয়েছেন এবং পরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন।
জাতিসংঘের দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের অনুসন্ধান কমিশনের নেতৃত্বে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের বিচারক নাভি পিল্লে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “গাজায় জাতিগত নিধন অব্যাহত রয়েছে। আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অন্তত চারটি বড় আকারের জাতিগত নিধনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই হত্যাযজ্ঞের দায়ভার ইসরাইলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপরই বর্তায়। তারা প্রায় দুই বছর ধরে এক গণহত্যামূলক অভিযান চালাচ্ছেন, যার মূল উদ্দেশ্য হলো গাজার ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করা।”
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরাইলে এক নজিরবিহীন হামলা চালায়। সে হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরাইলি নিহত হন এবং অন্তত ২৫০ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ঘটনার পরপরই ইসরাইল গাজা উপত্যকায় ব্যাপক ও নির্বিচার সামরিক হামলা শুরু করে, যা পরবর্তীতে এক নৃশংস গণহত্যায় রূপ নেয়।
প্রতিদিনের হামলায় বেসামরিক লোকজন, নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, গাজার হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র, এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত স্থাপনাও নির্বিচারে আক্রমণের শিকার হয়েছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসরাইলের হামলাগুলো কেবল সামরিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং একে সুসংগঠিত জাতিগত নিধন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
১. গাজার সাধারণ নাগরিকদের খাদ্য, পানি, বিদ্যুৎ ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া।
২. নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়ে হাজারো বাসাবাড়ি ধ্বংস করা।
৩. হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্রসহ নিরাপদ আশ্রয়স্থলগুলো টার্গেট করা।
৪. গাজার জনগণকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা ও প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা বন্ধ করা।
জাতিসংঘের এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত স্পষ্টভাবে জাতিগত নিধনের দায় চাপানো প্রতিবেদন এটাই প্রথম। যদিও এর আগে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একাধিকবার ইসরাইলের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ এনেছিল, কিন্তু জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনের গুরুত্ব অনেক বেশি।
অন্যদিকে, জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল মেরন প্রতিবেদনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এটিকে “স্ক্যান্ডালাস”, “মিথ্যা” এবং “হামাসের প্রোপাগান্ডা” বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মেরন বলেন, “ইসরাইল পুরোপুরি এই অনুসন্ধান কমিশনের প্রকাশিত মানহানিকর উগ্র মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করছে। এটি একটি পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট, যা হামাসের প্রক্সি দ্বারা রচিত।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতিসংঘের এই অনুসন্ধান প্রতিবেদন ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আদালত ও ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কারণ, প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে ইসরাইলি নেতাদের বক্তব্য, সামরিক পদক্ষেপ ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তকে গণহত্যার দায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এছাড়া, প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন গাজার মানবিক সংকট মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে যথাযথ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
গাজা উপত্যকায় চলমান সংঘাত এখন আর শুধু এক সামরিক লড়াই নয়, বরং মানবতার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এই প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে জানাচ্ছে— ইসরাইল কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং একটি জাতিগত নিধন চালাচ্ছে, যার লক্ষ্য হলো গাজার ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। আন্তর্জাতিক মহল এখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, জাতিসংঘের এই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে বিশ্ব শক্তিগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ