
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা ঘিরে সারাদেশে যাতে কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বিনষ্ট না হয়— সেই বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদসহ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এই আহ্বান জানান।
সভার শুরুতেই পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে আসন্ন দুর্গাপূজায় পূজামণ্ডপ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানান। পূজা উদ্যাপন উপলক্ষে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়ে নেতারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রধান উপদেষ্টা জানান, “আপনাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা সবসময়ই থাকে। তবে ব্যস্ততার কারণে সম্ভব হয় না। পূজার সময় অন্তত একবার হলেও দেখা করার, কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়— এটিই আনন্দের।”
তিনি পূজা উদ্যাপনের প্রস্তুতি ও সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নেতাদের কাছ থেকে বিস্তারিত জানতে চান।
ধর্মীয় নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, এ বছর সারা দেশে পূজামণ্ডপের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় এক হাজারেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম থেকে শহর, সর্বত্রই পূজা উদ্যাপনের প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ সহযোগিতার কারণে এ বছর পূজা আরও বেশি উৎসবমুখরভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেন।
বিশেষ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম এবং ধর্ম উপদেষ্টা ও সচিবের নিয়মিত যোগাযোগের কথা তারা উল্লেখ করেন। পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মন্দির পরিদর্শন থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার আন্তরিক ভূমিকা রাখছে।
বৈঠকে মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব রেল মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্থায়ী দুর্গামন্দিরের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়াকে একটি “ঐতিহাসিক ঘটনা” হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, “এজন্য আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর রেখেছেন। গত বছর ৮ আগস্ট দেশে ফেরার পরপরই তিনি ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন এবং বলেছিলেন, আমরা সবাই এক পরিবার। সেই বক্তব্য আমাদের মধ্যে গভীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।”
তিনি আরও জানান, এবছরও সরকারের পক্ষ থেকে দুর্গাপূজায় দুই দিনের ছুটি ঘোষণা করায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক সন্তোষ বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর তার বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার গত বছরের মন্তব্য স্মরণ করেন। তিনি বলেন, “গত বছর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজার সময় আপনি বলেছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে কড়া পাহারা বসিয়ে পূজা হবে— এমন দেশ আমরা চাই না। আমরা চাই, দেশের সব মানুষ সহযোগিতা করুক, মিলেমিশে থাকুক। আপনার বক্তব্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে।”
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব এস এন তরুণ দে বলেন, “আপনার নেতৃত্বে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য নজির স্থাপিত হয়েছে। গত এক বছর ধরে আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের মিথ্যা প্রচারণা ও ফেইক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আপনার নেতৃত্বে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কল্যাণ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।”
বৈঠকে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ধর্ম মন্ত্রণালয় সব ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছে। কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে কল্যাণমূলক নানা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে নতুন একটি মন্দির নির্মাণ এবং আরেকটি মন্দিরে স্নানাগারের জন্য সিঁড়ি নির্মাণের কাজের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি আরও জানান, অস্বচ্ছল মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জাগুলোকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি অস্বচ্ছল পরিবার, বিশেষ করে বিধবা নারী ও অনাথ আশ্রমগুলোকেও সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বৈঠকের শেষ দিকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও পূজার অগ্রিম শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, দুর্গাপূজা বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে উৎসব উপভোগ করে। তবে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের সুযোগ তৈরি না হয়, সেজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান তপন চন্দ্র মজুমদার ও সচিব দেবেন্দ্র নাথ উঁরাও, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী পূর্ণাআনন্দ (একক), বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর, মহানগর পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতির সভাপতি অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, শ্রী শ্রী গীতা হরি সংঘ দেব মন্দিরের সভাপতি শ্রী বিমান বিহারী তালুকদার, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের মহাসচিব এস এন তরুণ দে, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন ফ্রন্টের আহ্বায়ক অপর্না রায় দাস, শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত ও সিদ্ধেশ্বরী সার্বজনীন পূজা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রণীতা সরকার।
প্রধান উপদেষ্টার এই বৈঠক ও আহ্বানকে আসন্ন দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখরভাবে উদ্যাপনের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা হিসেবে দেখছে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ