
ছবি: সংগৃহীত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নয়া সমীকরণের খেলা। একদিকে দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও নিবন্ধন স্থগিত হয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে নেই, অন্যদিকে মাঠে শক্তিশালী অবস্থান নিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী এখন মুখোমুখি প্রতিযোগিতার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বিএনপি যেখানে জনগণের আস্থা ও ভোটে ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন দেখছে, সেখানে একসময়ের ক্ষুদ্র ভোটের দল জামায়াত ধীরে ধীরে নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। ফলে রাজনীতির মাঠে এক জটিল মেরূকরণের আভাস মিলছে।
বিএনপির কৌশল ও তারেক রহমানের সতর্কতা
দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী নির্বাচনের আগে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাধিক বৈঠকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, “আগামী নির্বাচন হবে সবচেয়ে কঠিন নির্বাচন। জনগণের কাছে যেতে হবে, জনগণের কাছে থাকতে হবে এবং জনগণকে সঙ্গে রাখতে হবে।” বিএনপি ইতোমধ্যে সমমনোভাবাপন্ন দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় এবং আসন ভাগাভাগির বিষয়েও আলোচনা শুরু করেছে। তারেক রহমান আরও আগে ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচনোত্তর সরকার হবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত একটি জাতীয় সরকার। এ ঘোষণার আলোকে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব সামনে রেখে বিএনপি জনগণের কাছে যাচ্ছে।
জামায়াতের উত্থান ও জোটের খেলা
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিত মাঠে জামায়াতে ইসলামী তাদের অবস্থান জোরদার করতে একাধিক ইসলামপন্থি দলকে নিয়ে জোট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম পার্টি (একাংশ), খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), এবি পার্টি এবং গণঅধিকার পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে একটি শক্তিশালী জোট তৈরির পরিকল্পনা করছে তারা। নির্বাচনের আগে এ জোট রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের দাবি—সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
বিশ্লেষকদের মতে, ডাকসু ও জাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের অবিশ্বাস্য সাফল্য জামায়াতকে জাতীয় নির্বাচনেও আশাবাদী করে তুলেছে। তাদের বিশ্বাস, ছাত্ররাজনীতির সাফল্য ধরে রাখলে জাতীয় রাজনীতিতেও তারা মিরাকল ঘটাতে সক্ষম হবে।
ছাত্ররাজনীতির প্রভাব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয়, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে বিপাকে ফেলেছে। সামনে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাকসু) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চাকসু) নির্বাচন। জামায়াত মনে করছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে জাতীয় নির্বাচনে তাদের জন্য নতুন দরজা খুলে যাবে। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতারা ছাত্র রাজনীতির এ ফলাফলের প্রভাব নিয়ে দ্বিমত পোষণ করছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে না। জাতীয় নির্বাচনের মঞ্চ অনেক বড়।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, “রাজনীতির মেরূকরণ এখন নতুন দিকে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি মুখোমুখি প্রতিযোগিতায় নামতে পারে। আবার বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কৌশলগত সমঝোতা গড়ে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তারেক রহমান যেহেতু জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে ইসলামপন্থি দলগুলোও এ উদ্যোগে শরিক হতে পারে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “শেষ পর্যন্ত ইসলামপন্থিরা এক লাইনে আসতে পারে। আবার বিরোধী দল হওয়ার জন্যও তারা একত্র হতে পারে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ও সেকুলার ঘরানার দলগুলোর মধ্যেও জোটবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। তবে বিএনপির বিপরীতে বিকল্প একটি শক্তি দাঁড়াতে আরও সময় লাগবে।”
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “আমরা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন চাই। বিভিন্ন দলের সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। যুগপৎ আন্দোলনের সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে এখনো কিছু চূড়ান্ত হয়নি।”
সামনে কী অপেক্ষা করছে
একসময়ের মাত্র ৫ শতাংশ ভোটের দল জামায়াত এখন বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় আছে। তাদের লক্ষ্য সংসদে শক্ত অবস্থান তৈরি করা, এমনকি সরকার গঠনের দৌড়েও নিজেদের জায়গা করে নেওয়া। বিএনপি যদিও এখনো প্রধান শক্তি হিসেবে মাঠে সক্রিয়, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জামায়াতের ধারাবাহিক কার্যক্রম এবং ছাত্রশিবিরের সাফল্য আগামী নির্বাচনে একটি ভিন্ন চিত্র তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতি তাই নতুন এক জটিল সমীকরণের পথে হাঁটছে—যেখানে আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে নেই, কিন্তু বিএনপি, জামায়াত ও তাদের সম্ভাব্য মিত্ররা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে এই সমীকরণ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ