
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল রাখা, রেমিট্যান্স প্রাপ্তি ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা এবং দীর্ঘমেয়াদে মুদ্রানীতি আরও টেকসই করে তোলা—এই লক্ষ্যেই গত দুই মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে মোট ১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই ক্রয় কার্যক্রম অর্থনীতির সামগ্রিক গতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় পরিশোধের সক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে।
একদিনেই রেকর্ড সংগ্রহ
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) একদিনেই ৩৫ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার কিনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, এটি চলতি সময়ের অন্যতম বড় একদিনের ক্রয়। এদিন মাল্টিপল প্রাইস অকশনের (Multiple Price Auction) মাধ্যমে মোট ২৬টি ব্যাংক থেকে ডলার কেনা হয়। প্রতি ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১২১ টাকা ৭৫ পয়সার মধ্যে।
নিলাম প্রক্রিয়ায় ডলার ক্রয়
গত ১৩ জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে। এর আগে বাজারে ডলারের ঘাটতি থাকায় বারবার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে, যাতে ভবিষ্যতে বাজারে ওঠানামা মোকাবিলা করার মতো পর্যাপ্ত রিজার্ভ গড়ে তোলা যায়।
ধারাবাহিক ক্রয় কার্যক্রম
সর্বশেষ বড় আকারের ডলার ক্রয় হয় ৯ সেপ্টেম্বর। সেদিনও বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে মোট ২৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছিল। তখন কাট-অফ রেট ধরা হয়েছিল প্রতি ডলারে ১২১ টাকা ৭০ পয়সা। অর্থাৎ কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিকবার বড় আকারে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
রিজার্ভ বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এসব ক্রয়ের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। একই সময়ে প্রবাসী আয়ও বাড়ছে। শুধু সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৩ দিনেই দেশে এসেছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
ব্যাংক খাতের প্রতিক্রিয়া
একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) বলেন, গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাত থেকে রপ্তানি আয়ের পরিমাণও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিনের আমদানি দায়, বিশেষত জ্বালানি আমদানির বিল পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে। আমদানি ব্যয় মেটানো এবং চাপ কমে আসার কারণে বর্তমানে বাজারে ডলারের সরবরাহ চাহিদার তুলনায় বেশি।
তিনি আরও বলেন, “এখন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে বিনিময় হার স্বাভাবিকভাবে নিচের দিকে নেমে আসছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনা বাজারকে ভারসাম্যে রাখতে সাহায্য করছে।”
নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি
অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবিষ্যতের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করছে। কারণ বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম বা খাদ্যপণ্যের আমদানি খরচ হঠাৎ বেড়ে গেলে তখন অতিরিক্ত ডলার রিজার্ভ কাজে লাগানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে বাজারে অতিরিক্ত ডলার ধরে রাখার কারণে টাকার মান অত্যধিক বেড়ে গেলে রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভারসাম্য বজায় রেখে ক্রয় কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা চলমান থাকবে। এর ফলে রিজার্ভ আরও বাড়বে এবং আগামী মাসগুলোতে বৈদেশিক লেনদেন আরও সহজ হবে। একই সঙ্গে মুদ্রানীতির আওতায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ রেমিট্যান্স প্রেরণকারী প্রবাসী বাংলাদেশি এবং রপ্তানিকারকদের আস্থা আরও বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই ধারা বজায় থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে আর আগের মতো অস্থিরতা দেখা দেবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ