
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রণীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ এর বাস্তবায়ন কৌশল চূড়ান্ত করতে না পারায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কমিশনকে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কমিশনকে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে কমিশনের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে কমিশনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে অতিরিক্ত সময় দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে কমিশনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তাই সময়সীমা বৃদ্ধি করে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হলো।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের ইতিহাসও খুব বেশি দিনের নয়। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৭ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিশন গঠিত হয়। গঠনের পর ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে কমিশনকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ছয় মাস সময় দেওয়া হয়েছিল, যা শেষ হয় গত ১৫ আগস্ট। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কমিশনের কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম দফায় তাদের মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এবার দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হলো।
এদিকে কমিশন ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করেছে। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ মার্চ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দুই দফায় ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রস্তাব ও মতামত সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে কমিশন গত ১৬ আগস্ট ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া উপস্থাপন করে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর পরামর্শ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত যুক্ত করে সনদটি চূড়ান্ত করা হয়।
তবে মূল সমস্যা দেখা দিয়েছে বাস্তবায়ন কৌশলকে ঘিরে। কোন কাঠামোর মাধ্যমে সনদটি বাস্তবায়িত হবে, তার প্রক্রিয়া ও কৌশল নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একেকটি দল ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরায় সবার মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। গত রবিবার কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সমঝোতা হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে কমিশন আগামী বুধবার আবারো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসবে। লক্ষ্য একটাই—জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল আরও বিলম্বিত হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র সংস্কারের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে বাস্তবায়ন কৌশল নিয়ে ঐকমত্য ছাড়া এই সনদ কার্যকর করা কঠিন হবে। তাই কমিশনের বাড়তি সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে গঠনমূলক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে সাধারণ নাগরিক সমাজ থেকেও এই কমিশনের প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। অনেকের মতে, যদি সনদটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সংকট কমাতে এটি বড় ভূমিকা রাখবে। তবে আশঙ্কার কথাও উচ্চারিত হচ্ছে—যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে সরে না আসে, তবে কমিশনের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
সব মিলিয়ে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা তৈরির কাজ এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও সামনে রয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জ। এখন দেখার বিষয়, আগামী এক মাসে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা নমনীয় হয় এবং কমিশন কতটা কার্যকর সমঝোতা টানতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ