
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল বৃদ্ধির সরকারি প্রজ্ঞাপন অবশেষে কার্যকর হলো। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনায় থাকা এবং ব্যবহারকারীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত নতুন মাশুল কার্যকর হলো সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে। রবিবার দিবাগত রাতে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটি কার্যকর হয়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগের তুলনায় গড়ে ৪১ শতাংশ হারে মাশুল বেড়েছে, যা সরাসরি দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতকে প্রভাবিত করবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করছে ব্যবসায়ীরা।
প্রথমবারে এত বড় বৃদ্ধি
চট্টগ্রাম বন্দর ১৯৮৬ সালের পর এবারই প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে মাশুল সমন্বয় করল। প্রায় চার দশক ধরে একই হারে মাশুল চালু থাকলেও এবার এক লাফে গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়ানো হলো। সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন মাশুল না বাড়ানোয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য আনার প্রয়োজন ছিল। তবে ব্যবহারকারীদের মতে, এত হঠাৎ বড় বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কনটেইনারে সর্বোচ্চ চাপ
সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে কনটেইনারভিত্তিক পরিবহনে। বর্তমানে একটি ২০ ফুট কনটেইনার থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ গড়ে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা আদায় করে আসছিল। নতুন মাশুল কার্যকর হলে প্রতিটি কনটেইনারে অতিরিক্ত দিতে হবে গড়ে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। অর্থাৎ এখন প্রতিটি কনটেইনারে মোট খরচ দাঁড়াবে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। এতে গড়ে ৩৭ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরও খুঁটিনাটি হিসাব করলে দেখা যায়, আমদানি কনটেইনারে অতিরিক্ত দিতে হবে ৫ হাজার ৭২০ টাকা এবং রপ্তানি কনটেইনারে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। অর্থাৎ একই পণ্য কাঁচামাল হিসেবে দেশে আনা এবং তৈরি পণ্য হিসেবে বিদেশে পাঠানোর সময় ব্যবসায়ীদের দু’দফায় বাড়তি মাশুল দিতে হবে।
ডলারের সঙ্গে খরচও বাড়বে
নতুন মাশুল কাঠামোতে ডলারকে ভিত্তি ধরা হয়েছে। প্রতি ডলারের দাম ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। তবে যদি ডলারের বাজারমূল্য আরও বেড়ে যায়, তাহলে মাশুলও অনুপাতে বাড়বে। অর্থাৎ আমদানি-রপ্তানিকারকদের খরচ ভবিষ্যতে আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জাহাজ থেকে ওঠানো-নামানোর খরচ দ্বিগুণের পথে
নতুন মাশুল বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় খাত হলো জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো। আগে প্রতিটি কনটেইনার ওঠানো বা নামানোর জন্য মাশুল ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার। এখন তা বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি কনটেইনারে প্রায় ২৪ দশমিক ৬০ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় তিন হাজার টাকার মতো বেশি দিতে হবে।
একইভাবে কনটেইনারভিত্তিক পণ্যের কেজিপ্রতি খরচও বেড়েছে। আগে যেখানে গড়ে ১ টাকা ২৮ পয়সা মাশুল দিতে হতো, এখন নতুন হারে অতিরিক্ত ৪৭ পয়সা দিতে হবে।
ভোক্তার ওপর প্রভাব ও ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
ব্যবহারকারীরা বলছেন, মাশুল বৃদ্ধির চাপ শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে। কারণ উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যয় বাড়লে তা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যে প্রতিফলিত হবে। বিজিএমইএ পরিচালক ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব সরাসরি বলেছেন, “সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক খাত। কারণ একই পণ্য কাঁচামাল হিসেবে দেশে আনতে হবে একবার, আবার তৈরি পোশাক রপ্তানি করার সময় দিতে হবে দ্বিতীয়বার। অর্থাৎ একই পণ্যে দুইবার মাশুল পরিশোধ করা একেবারেই অযৌক্তিক।”
বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা
ব্যবহারকারীদের আরেকটি আশঙ্কা হলো—নতুন মাশুল কার্যকর হলে ভবিষ্যতে বন্দর ব্যবস্থাপনার বড় অংশ বিদেশি অপারেটরদের হাতে চলে যাবে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের দুটি টার্মিনাল ছাড়া বাকি অনেক অংশ বিদেশি কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। মাশুল বৃদ্ধির সুবিধা শেষ পর্যন্ত তারাই বেশি ভোগ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সরকারের যুক্তি
সরকার বলছে, ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম মাশুল সমন্বয় করা হলো। বাড়ানোর পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মাশুল কম রয়েছে। ফলে এটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সামঞ্জস্য আনার একটি উদ্যোগ।
সাধারণ পণ্য পরিবহনে প্রভাব
চট্টগ্রাম বন্দরে শুধু কনটেইনারভিত্তিক পণ্য নয়, সাধারণ পণ্যও আসে। তবে সেখানেও মাশুল বেড়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সব ধরনের পণ্যে কেজিপ্রতি গড়ে ১৪ পয়সা মাশুল বাড়বে। বর্তমানে যেখানে প্রতি কেজিতে ৩৫ পয়সা দিতে হয়, নতুন হারে তা দাঁড়াবে প্রায় ৪৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রায় ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি।
তবে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজগুলো বন্দর সুবিধা তুলনামূলক কম ব্যবহার করে। যেমন বাল্ক জাহাজের বেশিরভাগই সাগরে নোঙর করে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দরের মোট পণ্যের প্রায় ৫৯ শতাংশ খালাস হয়েছে বহির্নোঙরে। ফলে এই অংশে চাপ তুলনামূলক কম পড়বে।
অর্থনীতিতে বড় প্রভাব
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯৯ শতাংশ এবং আমদানি কাঁচামালের বেশিরভাগই কনটেইনারের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসে। ফলে এখানে মাশুল বাড়ানো মানে সরাসরি দেশের শিল্পখাত ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ব্যয় বেড়ে যাওয়া। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বৃদ্ধি দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ