
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে তীব্র গরম এখন আর কেবল মৌসুমি অস্বস্তি নয়, বরং জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৪ সালেই অতিরিক্ত গরম ও তাপপ্রবাহের কারণে প্রায় ২৫ কোটি কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১.৩৩ থেকে ১.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির প্রায় ০.৩ থেকে ০.৪ শতাংশের সমান। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘অ্যান আনসাসটেইনেবল লাইফ: দ্য ইমপ্যাক্ট অব হিট অন হেলথ অ্যান্ড দ্য ইকোনমি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক।
কর্মদিবস হারানোর পেছনের কারণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যখন তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তখন কর্মীদের শারীরিক সক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। দীর্ঘ সময় ধরে গরমে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর ফলে কর্মস্থলে অনুপস্থিতি বাড়ে এবং উৎপাদনশীলতা কমে যায়। কৃষি, নির্মাণ, পোশাক শিল্পসহ শ্রমনির্ভর খাতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
বিশ্বব্যাংক বলছে, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তবে আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ‘ফিলস লাইক টেম্পারেচার’ বা অনুভূত তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এতে মানুষের শরীরের ওপর চাপ বহুগুণে বেড়েছে।
স্বাস্থ্যের ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব
তীব্র গরম কেবল উৎপাদনশীলতা কমাচ্ছে না, বাড়াচ্ছে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক অসুখ-বিসুখও। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অতিরিক্ত তাপের কারণে ডায়রিয়া, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, চরম ক্লান্তি ইত্যাদি রোগ বেড়েছে। বিশেষত গ্রীষ্মকালে এসব রোগের প্রকোপ শীতকালের তুলনায় দ্বিগুণ।
এছাড়া তাপপ্রবাহের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যারও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তীব্র গরমে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ বেড়ে যায়, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বয়সের সঙ্গে এ সমস্যা আরও প্রকট হয়। ৫০ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের মধ্যে তাপজনিত শারীরিক ও মানসিক সমস্যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি।
ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ
বাংলাদেশ বর্তমানে উচ্চ তাপমাত্রার ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। রাজধানী ঢাকা তাপপ্রবাহের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত এলাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার তাপসূচক জাতীয় গড়ের তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি। শহরে দ্রুত নগরায়ণ, যানজট, দালানকোঠার ঘনত্ব ও সবুজায়নের অভাব মিলিয়ে রাজধানীর বাসিন্দারা গরমের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন।
বিশ্বব্যাংকের সতর্কবার্তা ও সুপারিশ
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের ডিভিশন ডিরেক্টর জ্যাঁ পেসমে বলেন,
“তীব্র গরম শুধুই মৌসুমি সমস্যা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে। আমরা দেখছি, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য, উৎপাদনশীলতা এবং সামগ্রিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। তবে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে এ প্রভাব কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।”
প্রতিবেদনের সহ-লেখক ও বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার ইফফাত মাহমুদও বলেন,
“গরমে স্বাস্থ্য সমস্যা এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাসের মধ্যে সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই।”
প্রতিবেদনে তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবিলায় কিছু জরুরি করণীয়ও সুপারিশ করা হয়েছে—
বহু-খাতভিত্তিক জাতীয় প্রস্তুতি বাড়ানো
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সজ্জিত ও প্রস্তুত রাখা
শহরে সবুজায়ন বৃদ্ধি করা
কর্মক্ষেত্রে তাপজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার করা
কেন এখনই পদক্ষেপ জরুরি
গরমের কারণে যে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, তা দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনকে কঠিন করে তুলতে পারে। প্রতি বছর কর্মদিবস নষ্ট হওয়া মানে শ্রমঘণ্টার অপচয় এবং উৎপাদনশীলতার ঘাটতি, যা সরাসরি জাতীয় আয়ে প্রভাব ফেলছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় চিকিৎসা খরচও বেড়ে যাচ্ছে, যা পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়ের ওপরই বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যদি এখনই জরুরি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে তাপপ্রবাহের প্রভাব আরও মারাত্মক হবে। নগর পরিকল্পনা, পরিবেশ সংরক্ষণ, জনস্বাস্থ্য এবং শ্রমনীতি—সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
বাংলাদেশের জন্য এই সতর্কবার্তা কেবল পরিসংখ্যান নয়, বরং বাস্তব সংকটের প্রতিচ্ছবি। তীব্র গরম এখন জনজীবনের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ, আর এর প্রভাব মোকাবিলায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য—দুই দিকেই বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ