
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ এক মাইলফলক হলো স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ। জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে এই মর্যাদা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রপ্তানি নির্ভরতা, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং বিনিয়োগের ঘাটতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার এই গ্রাজুয়েশন বা উত্তরণের সময়সীমা কিছুটা পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, সরকার এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে অতিরিক্ত আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত এক কর্মশালায় বাণিজ্য সচিব এ কথা বলেন। তিনি খোলামেলা স্বীকার করেন, এলডিসি থেকে গ্রাজুয়েশন পেছানোর বিষয়ে সরকার "নীচু স্বরে" কথাবার্তা চালাচ্ছে। সচিব বলেন, “তিন বছর পেছানো গেলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। তবে খুব বেশি আশা করার সুযোগ নেই।”
বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পথে রয়েছে। কিন্তু গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশ বহু আন্তর্জাতিক সুবিধা হারাবে। বর্তমানে এলডিসি মর্যাদার কারণে রপ্তানিতে বিশেষ শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, উন্নয়ন সহযোগীদের অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণ, এবং বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। একবার উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় গেলে এসব সুবিধা আর বহাল থাকবে না।
বাণিজ্য সচিব বলেন, “গ্রাজুয়েশন থামাতে হলে জাতিসংঘে পাস করাতে হবে। উত্তরণের সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভোটের মাধ্যমে প্রস্তাব আনতে হয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই একবার প্রস্তাব এনেছিল। এখন আবারো যেসব দেশ জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রভাব ফেলতে পারে, তাদের সঙ্গে সরকার যোগাযোগ রাখছে।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এলডিসি সুবিধা হারালে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খাবে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি, সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারালে প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জন্য সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ নয়। সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ বিষয়ে ভোটাভুটি করতে হয়। কোনো প্রস্তাব গৃহীত হলে তবেই বাংলাদেশ অতিরিক্ত সময় পেতে পারে। এর আগে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাংলাদেশ একবার সময়সীমা পিছিয়েছে। তবে দ্বিতীয়বার সময় বাড়ানো সহজ হবে না।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বড় অর্থনীতি, উন্নয়ন সহযোগী এবং বৈশ্বিক প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে সমর্থন আদায় করাই মূল চ্যালেঞ্জ।
কর্মশালায় বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সে কারণেই ট্যারিফ টিম (ইউএসটিআর) বাংলাদেশ সফরে এসেছে। তারা আমাদের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছে।”
তিনি আরও বলেন, বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগের ঘাটতি। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছে না। সচিব মনে করেন, রিজার্ভ শক্তিশালী হলে বিনিয়োগ ফের বাড়তে শুরু করবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, বৈদেশিক ঋণ শোধের চাপ, ডলার সংকট এবং বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল অবস্থায় আছে। এমন বাস্তবতায় গ্রাজুয়েশন বিলম্বিত হলে কিছুটা শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ একদিকে গৌরবের, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জও বটে।
-
সুবিধা: এটি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি ও সক্ষমতার স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আস্থা বাড়বে।
-
ঝুঁকি: শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা হারানো, সহজ ঋণপ্রাপ্তি কমে যাওয়া, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চাপ।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, যদি যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যায়, তবে রপ্তানি আয়, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগ—সবখানেই সংকট তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ যদি সময়সীমা পিছিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়, তবে দেশকে এখনই কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে।
-
রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণ করতে হবে। কেবল পোশাক নির্ভরতা কমিয়ে আইটি, ওষুধ, কৃষিজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল ইত্যাদি খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
-
বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে স্থিতিশীল নীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও সহজ ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
-
বৈদেশিক রিজার্ভ শক্তিশালী করতে রেমিট্যান্স বাড়ানো এবং রপ্তানি আয় সঠিকভাবে দেশে আনা জরুরি।
-
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য এলডিসি গ্রাজুয়েশন নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। তবে অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিলে সময়সীমা পেছানোর উদ্যোগ এক ধরনের প্রয়োজনীয় বাস্তবতা। সরকার এখন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সময় বাড়াতে পারবে কি না, তা নির্ভর করবে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর অবস্থান এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ