
ছবি: সংগৃহীত
দেশে বর্ষাকাল এলেই এডিস মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। বিশেষ করে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া—দুটি ভাইরাসজনিত রোগ একই সময়ে ছড়িয়ে পড়ায় অনেক সময় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। উপসর্গগুলো কাছাকাছি হওয়ায় প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে রোগী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন, কারণ সঠিক রোগ নির্ণয় না হলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এগুলো জানা থাকলে রোগ দ্রুত শনাক্ত করা যায় এবং চিকিৎসাও সহজ হয়ে ওঠে।
ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য
-
ডেঙ্গু সাধারণত ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে জটিলতার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।
-
চিকুনগুনিয়া সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিনে সেরে যায়। তবে রোগীর জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির ব্যথা দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারে।
-
ডেঙ্গু জ্বরে শরীরে র্যাশ বা লাল দাগ দেখা যায়, আবার নাক, চোখ বা শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণও হতে পারে। অন্যদিকে চিকুনগুনিয়াতে র্যাশ তেমন হয় না, তবে অস্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।
-
ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যায়, কিন্তু চিকুনগুনিয়াতে এ ধরনের সমস্যা হয় না।
ডেঙ্গুর বিস্তারিত উপসর্গ
১. ডেঙ্গুতে তীব্র উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর হয়, তবে সর্দিকাশি থাকে না।
২. জ্বর শুরুর ৪ থেকে ৫ দিনের মাথায় শরীরে লালচে র্যাশ দেখা দেয়।
৩. ডেঙ্গু রোগীরা অনেক সময় শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হন, যা জীবনহানির ঝুঁকি বাড়ায়।
৪. রক্তে প্লাটিলেট কমতে থাকে, ফলে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়।
৫. চোখের পেছনে তীব্র ব্যথা, শরীর ভাঙা ভাব, কোমর ও মাংসপেশিতে ব্যথা হয়।
৬. জ্বর কিছুটা কমলেও প্লাজমা লিকেজ, হিমাটোক্রিট পরিবর্তন, রক্তচাপ কমে যাওয়া বা ফুসফুসে পানি জমার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
৭. ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের লিভার, হার্ট, কিডনি পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৮. রোগীর বমিভাব এবং খাবার গ্রহণে অনীহা থাকে।
৯. সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি।
চিকুনগুনিয়ার বিস্তারিত উপসর্গ
১. জ্বর শুরু হওয়ার পর দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে তীব্রতা কিছুটা কমে যায়, তবে কয়েকদিন পর আবারও জ্বর দেখা দিতে পারে। এই জ্বর ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে।
২. রোগীর দেহের গিঁটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। হাঁটাচলায় অসুবিধা হয়, অনেক সময় হুইলচেয়ার বা অন্যের সাহায্য নিতে হয়। এজন্য একে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ বলা হয়।
৩. প্লাটিলেট কমে যাওয়া বা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থাকে না।
৪. ৭০ শতাংশ রোগী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান, তবে জয়েন্টের ব্যথা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।
৫. স্কিন বা চামড়ায় কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।
৬. লিভার, হার্ট, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই, তবে ব্যথার কারণে রোগী দীর্ঘদিন কষ্ট পান।
৭. মৃত্যুঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে।
রোগ শনাক্তকরণ
চিকিৎসকেরা সাধারণত রোগীর শারীরিক পরীক্ষা ও উপসর্গের ভিত্তিতেই রোগ চিহ্নিত করেন। প্রয়োজন হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে প্লাটিলেটের অবস্থা, হিমোগ্লোবিন ও অন্যান্য সূচক নির্ণয় করা হয়।
জ্বর হলে করণীয়
১. ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া—দুই রোগের ক্ষেত্রেই প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। পানি, ডাবের পানি, জুস, শরবত, গ্লুকোজ, স্যুপ খেলে শরীরে পানিশূন্যতা দূর হয়।
২. জ্বর বা বমির কারণে খাবার গ্রহণে সমস্যা হলে স্যালাইন দেওয়া যেতে পারে। ফলমূল বেশি খাওয়া জরুরি।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে ব্যথানাশক খাওয়ার আগে রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করতে হবে।
৪. রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
5. ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রক্তে প্লাটিলেট অত্যধিক কমে গেলে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
6. চিকুনগুনিয়ায় ব্যথা কমাতে ঠান্ডা ছ্যাঁক দেওয়া বা হালকা ব্যায়াম সহায়ক হতে পারে।
7. উভয় রোগেই নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
চিকিৎসকদের পরামর্শ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি হলেও চিকুনগুনিয়া রোগীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগ তৈরি করে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ দুই-ই বাড়ছে। তাই সচেতনতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং মশা নিয়ন্ত্রণই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, হেলথলাইন
বাংলাবার্তা/এমএইচ