ছবি: সংগৃহীত
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে আবারও অনিশ্চয়তার আবহ তৈরি হয়েছে। গণভোটের সময় নির্ধারণ ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য এখন আরও গভীর হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার বল দলগুলোর কোর্টে ছুড়ে দেওয়ার পর তিন দিন পার হলেও, ঐকমত্যের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি–জামায়াত ও তাদের মিত্র জোটের অবস্থান একদিকে অনড়, অন্যদিকে সরকারপন্থী বা মধ্যপন্থী দলগুলোও কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সোমবার ‘জরুরি বৈঠক’ শেষে ঘোষণা দিয়েছিল, দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এক সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে সিদ্ধান্ত জানাবে। উপদেষ্টা পরিষদের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সেই বৈঠকের পর জানিয়েছিলেন, “সরকার অনেক আলোচনা করেছে, এখন দলগুলোকেই ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে হবে। আমরা কোনো আলটিমেটাম দিইনি, শুধু আহ্বান জানিয়েছি—দলগুলো যেন যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সরকারের কাছে দিকনির্দেশনা দেয়।”
তবে সময় গড়িয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো দলই বাস্তব অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। বরং, বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য ও সমাবেশে দেখা যাচ্ছে একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস ও কঠোর অবস্থান।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট এবং জামায়াত ইসলামী এখনো তাদের নিজস্ব অবস্থানে অনড় রয়েছে। বিএনপির দাবি, গণভোট হতে হবে জাতীয় নির্বাচনের দিনেই, এর আগে নয়। দলটি বলছে, নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের প্রতি আস্থা বাড়বে এবং এটি প্রশাসনিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য হবে।
অন্যদিকে, জামায়াত ইসলামী বলছে, গণভোট আগে হতে হবে, কারণ নির্বাচনের আগে জনগণের মতামত যাচাই না করলে জুলাই সনদ বা নতুন নির্বাচনি কাঠামো অর্থবহ হবে না। তাদের যুক্তি, নির্বাচনের আগে গণভোট হলে সেটিই হবে জনগণের প্রকৃত রায়।
এই অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। যদিও দুই দলেরই অভিন্ন লক্ষ্য—অন্তর্বর্তী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন ও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন—তবে কৌশলগত অবস্থানে তারা একমত হতে পারছে না।
বুধবার জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিক সংলাপের জন্য দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা হলেন দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, বিএনপি ও অন্যান্য জোটের সঙ্গে যোগাযোগ করে গণভোট ও জুলাই সনদ বিষয়ে একটি সমঝোতার রূপরেখা তৈরি করা।
ডা. তাহের বৃহস্পতিবার রাজধানীর পল্টনে এক সমাবেশে বলেন, “সময় খুব সীমিত। আমরা আলোচনা শুরু করতে চাই। আমি আজ সকালে বিএনপি মহাসচিবকে ফোন করেছি, পাইনি—তবে আবারও কল করব। আশা করি, বিএনপিও তাদের পক্ষ থেকে আলোচনায় বসবে।”
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তিনি টেলিফোনে বলেন, “ডা. তাহেরের বক্তব্য সঠিক নয়, আমাদের মধ্যে কথা হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “দলগুলোর কোর্টে বল ঠেলে সরকার কৌশলী খেলা খেলেছে। এক বছর ধরে আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসেছি, আলোচনা করেছি—তাহলে আবার আমাদেরই আলোচনায় বসতে বলার অর্থ কী? সরকার আসলে দায় এড়াতে চাইছে।”
এদিকে, রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে ছয়দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি এবং আরও কয়েকটি দল একত্রে নয় দলের একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের লক্ষ্য—বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে একটি সাধারণ রূপরেখা তৈরি করা।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “আমরা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। তাদের অনুরোধ করেছি—গণভোট সংসদ নির্বাচনের দিনেই হলে দেশ বাঁচবে। কিন্তু তারা নানা যুক্তি দেখিয়ে নিজেদের অবস্থানে অটল। এখন আমরা বিএনপির সঙ্গেও কথা বলব। কিন্তু মনে হচ্ছে, দুই পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। তারা যদি অনড় থাকে, তাহলে আমাদের আলোচনাও সময়ের অপচয় হবে।”
বৃহস্পতিবার যশোরে প্রয়াত বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামের স্মরণসভায় মির্জা ফখরুল বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে, এর আগে নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়াচ্ছে। আমরা তো হাতের খেলনা নই। কমিশনের সঙ্গে বসে বহু প্রস্তাব দিয়েছি, এখন সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
অন্যদিকে, রাজধানীর পল্টনে অনুষ্ঠিত সমাবেশে জামায়াতের ডা. তাহের বলেন, “নির্বাচনের আগে গণভোট দিতে হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও আইনি বাধা নেই। যদি সোজা আঙুলে ঘি না ওঠে, তবে আঙুল বাঁকা করতে হবে।” তার বক্তব্যে ইঙ্গিত ছিল—জামায়াত গণভোট ইস্যুতে কঠোর আন্দোলনে যেতে প্রস্তুত।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সোমবারের বৈঠকে বলেন, “সরকার সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিক। তাদের দিকনির্দেশনা পেলে সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। আমরা অপেক্ষা করব, তারপর সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”
এদিকে বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “অফিশিয়ালি কিছু না হলেও দলগুলোর মধ্যে আনঅফিশিয়ালি আলোচনা চলছে। সাত দিনের সময় দেওয়া হয়েছে। যদি তারা সিদ্ধান্তে না পৌঁছায়, তাহলে সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। সে প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের মঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে। পুরো জাতি এখন অপেক্ষায়—কবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। জনগণ চায়, এই অনিশ্চয়তা শেষ হোক।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই সনদ ও গণভোট ইস্যুটি এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “গণভোটের সময় নির্ধারণ এখন কেবল কৌশলগত প্রশ্ন নয়, এটি রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণের সূচক হয়ে গেছে। বিএনপি চায় গণভোট ও নির্বাচনের বৈধতা একই দিনে প্রমাণিত হোক, আর জামায়াত চায় আগে গণভোটের মাধ্যমে জনমত যাচাই হোক।”
আরেক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুবুল হক মনে করেন, “সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না পায়, তাহলে নিজস্ব সিদ্ধান্তই কার্যকর করবে। এতে গণভোটের সময় নির্ধারণে নতুন বিতর্ক তৈরি হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়—দলগুলোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সাত দিনের সময়সীমার অর্ধেক পার হলেও ঐকমত্যের আলো দেখা যায়নি। বিএনপি–জামায়াত ও তাদের সহযোগী দলগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে এক চুল নড়তে রাজি নয়, অন্যদিকে মধ্যপন্থী দলগুলোও নিরপেক্ষ সেতুবন্ধন তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ফলে প্রশ্ন উঠছে—দলগুলো যদি নিজেরা সমঝোতায় না পৌঁছায়, তাহলে কি সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে?
রাজনীতির অঙ্গনে এখন সেই উত্তরই সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



