ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য মানচিত্রে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর এখন দ্রুত রূপ নিচ্ছে একটি বিশ্বমানের আধুনিক ট্রানজিট হাবে। দেশের আমদানি–রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়, এবং এখন লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এমন একটি অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত রূপান্তর, যা শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য প্রবাহকেও প্রভাবিত করবে।
বর্তমানে বন্দরটি বছরে প্রায় ৩৩ লাখ টিইইউ (২০-ফুট সমতুল্য ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে। কিন্তু ২০৪০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা চার গুণ বাড়িয়ে প্রায় ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউতে উন্নীত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। এই বিশাল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম ও দক্ষ সমুদ্রবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বন্দরের দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতা বৃদ্ধির রোডম্যাপ উপস্থাপন করা হয়। সেখানে ধাপে ধাপে ২০২৫ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। এই প্রস্তাব পরবর্তীতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, যা বর্তমানে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে।
বন্দরের ত্রিপঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে বছরে ১৩ লাখ টিইইউ এবং জেনারেল কার্গো বার্থে প্রায় ২০ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং করা হয়—মোট সক্ষমতা ৩৩ লাখ টিইইউ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বন্দরের সামগ্রিক সক্ষমতা ৪০ লাখ টিইইউতে উন্নীত হবে।
এরপর ধাপে ধাপে বেড়ে ২০৩৫ সালে হবে প্রায় ৬০ লাখ টিইইউ, এবং ২০৪০ সালে নতুন টার্মিনালগুলো চালু হলে সক্ষমতা পৌঁছাবে ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউতে, যা বর্তমানের প্রায় চার গুণ।
চট্টগ্রাম বন্দরের রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একাধিক বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প—
-
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প: এই প্রকল্প কার্যত বাংলাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর, যা বৃহৎ জাহাজের আগমন সম্ভব করবে। বন্দরের প্রথম ধাপ ২০২৭ সালের মধ্যেই চালু হওয়ার সম্ভাবনা। দ্বিতীয় ধাপের কাজ ২০৩৫ সালের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
-
বে টার্মিনাল (সিটি-১ ও সিটি-২): প্রথম পর্যায় দ্রুত এগোচ্ছে; ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং সক্ষমতা যোগ হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১৮ লাখ টিইইউ যোগ হবে।
-
লালদিয়া টার্মিনাল: বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে নির্মাণের প্রস্তাব চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই টার্মিনাল বন্দরের পশ্চিমাঞ্চলীয় লজিস্টিক কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করবে।
-
পতেঙ্গা টার্মিনাল: ইতোমধ্যে পূর্ণ সক্ষমতায় চালু আছে এবং বর্তমানে এটি বন্দরের অন্যতম ব্যস্ততম অংশ।
এই সব প্রকল্প মিলিয়ে ২০৪০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা দাঁড়াবে ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউ—যা জাইকার সহযোগিতায় পরিচালিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল পোর্ট স্ট্র্যাটেজি প্রকল্পের বেসলাইন রিপোর্টেও নির্ধারিত লক্ষ্য।
এই মহাপরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন শুধু বন্দরের ভেতরের উন্নয়নের ওপর নির্ভর করছে না—বরং দেশের অভ্যন্তরীণ সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগের সমন্বয় এর ওপরও নির্ভর করছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তিনটি মন্ত্রণালয় (নৌ, সড়ক ও রেল) এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ছাড়া এই প্রকল্প টেকসই হবে না।
বিশেষ করে, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে বে টার্মিনাল হয়ে টেকনাফ পর্যন্ত সড়ক ও রেল সংযোগ আধুনিকায়নের জন্য আলাদা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এই রুটটি দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চল এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে ছয়টি রুটে তিন জোড়া ট্রেনে কনটেইনার পরিবহন করছে। লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে আটটি রুটে এই সেবা বাড়ানো। পাশাপাশি মাতারবাড়ী টার্মিনালের দ্বিতীয় ধাপ চালু হলে ফাসিয়াখালী সংযোগ সড়ক ও রেলপথে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে—তাই আগেভাগেই সমন্বয় শুরু করার সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “আমরা এখন এমন এক সময়ে আছি, যখন বন্দরের প্রতিটি উন্নয়ন ধাপ ভবিষ্যতের বাণিজ্য প্রবাহকে নির্ধারণ করবে। পতেঙ্গা টার্মিনাল পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে, বে টার্মিনালের অগ্রগতি দ্রুত, এবং মাতারবাড়ী প্রকল্প পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০৪০ সালের মধ্যেই আমরা ১ কোটি ৭ লাখ টিইইউ হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় পৌঁছাব।”
চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি আমির হুমায়ুন চৌধুরী বলেন, “বন্দরের উন্নয়ন নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, কিন্তু এর প্রতিটি প্রকল্পে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। এসব কাজ যেন বিদেশিদের হাতে একচেটিয়া না যায়, সে বিষয়ে সরকারকে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের প্রত্যাশা—সব টেন্ডার ও চুক্তি ওপেন এবং প্রতিযোগিতামূলকভাবে সম্পন্ন হোক, যাতে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।”
ব্যবসায়ী নেতারা আরও বলেন, বন্দর সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে কাস্টমস, ক্লিয়ারিং ও লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা ডিজিটালভাবে উন্নত করতে হবে। কারণ, শুধুমাত্র অবকাঠামো উন্নয়ন যথেষ্ট নয়—দ্রুত কনটেইনার ক্লিয়ারিং, উন্নত ডকুমেন্টেশন এবং রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং ব্যবস্থা চালু না হলে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০৪০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, নেপাল ও ভুটানের জন্যও এই বন্দর একটি বিকল্প বাণিজ্য রুট হয়ে উঠবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বন্দরটির এই উন্নয়ন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি ১.৫ থেকে ২ শতাংশ অবদান রাখতে পারে। পাশাপাশি বন্দরনির্ভর শিল্পাঞ্চল, গুদাম, পরিবহন ও সেবা খাতে লক্ষাধিক নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালন কেন্দ্র। সেটিকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এই পরিকল্পনা যদি পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশ শুধু পণ্য রপ্তানিতে নয়—বরং আঞ্চলিক লজিস্টিক হাবে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে।
এই বন্দরই হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী অর্থনৈতিক বিস্ময়ের সূচনা বিন্দু।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



