ছবি: সংগৃহীত
সাবেক সংসদ সদস্যদের (এমপি) নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে জটিলতা আরও গভীর হয়েছে। এসব গাড়ি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর (ডিওটি)-এর কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হলেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এখন এসব গাড়ির বিপরীতে ১৭৫ কোটি টাকার শুল্ক ও বন্দর চার্জ দাবি করেছে। ফলে নিলাম ও হস্তান্তর উভয় প্রক্রিয়াই আপাতত স্থবির হয়ে পড়েছে।
ঘটনাটির সূত্রপাত হয় ২০২৪ সালের মাঝামাঝি, যখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সাবেক সদস্যরা তাদের মেয়াদ শেষে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়িগুলো খালাস করতে ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তাদের সেই সুবিধাও বাতিল হয়ে যায়। এরপর গাড়িগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে আটকা পড়ে, যা পরিণত হয় প্রশাসনিক জটিলতার বড় ইস্যুতে।
গত মাসের শেষ দিকে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সাবেক এমপিদের জন্য আমদানি করা এই ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে (ডিওটি) হস্তান্তর করা হবে। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে লিখিত নির্দেশও পাঠানো হয়।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই এনবিআর নতুন আরেকটি চিঠি পাঠিয়ে পূর্বের নির্দেশ স্থগিত করে দেয়। এনবিআরের স্থগিতাদেশের পরই সামনে আসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব ও বন্দরের ডেমারেজ সংক্রান্ত জটিলতা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দাবি, এসব গাড়ি যদি নিলামে বিক্রি করা হতো, তাহলে সরকার প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব পেত। তাই তারা এখন সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কাছে সমপরিমাণ অর্থ দাবি করেছে, পাশাপাশি বন্দরের চার্জ ও ডেমারেজ পরিশোধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উপকমিশনার (নিলাম) মো. রাসেল আহমেদ বলেন, “আমরা এনবিআরের নির্দেশ অনুযায়ী গাড়িগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরবর্তী চিঠিতে আদেশ স্থগিত করা হয়। আইন অনুযায়ী, এসব গাড়ির শুল্ক ও বন্দর চার্জ পরিশোধ ছাড়া হস্তান্তর সম্ভব নয়। অন্যথায়, এগুলো সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে।”
তিনি আরও জানান, গাড়িগুলোর মূল্য ও শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে সরকারি নিয়মে। এখন পর্যন্ত কোনো দপ্তর সেই দায়ভার নিতে রাজি হয়নি, ফলে পুরো প্রক্রিয়া ঝুলে আছে।
এর আগে ২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ৪৪টি গাড়ির ই-নিলাম আয়োজন করে, যার মধ্যে ২৪টি ছিল এই শুল্কমুক্ত গাড়ি। কিন্তু নিলামে অংশ নেওয়া একটি সিন্ডিকেট মাত্র ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকার মধ্যে দর দিয়ে ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের গাড়ি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ, যে ল্যান্ড ক্রুজার গাড়িটির বাজারমূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা, সেটির জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৫০ হাজার টাকা। নিলামের শর্ত অনুযায়ী, ভিত্তিমূল্যের ৬০ শতাংশ পূর্ণ না হলেও দ্বিতীয় নিলামে সামান্য বাড়তি দর দিলেই গাড়িগুলো বিক্রি হয়ে যেত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট পুরো চালান নিজেদের হাতে নিতে চেয়েছিল বলে দুদক ও কাস্টম সূত্রে জানা গেছে।
ঘটনার পর নিলাম কার্যক্রম স্থগিত করে কাস্টম হাউস এবং এনবিআর। সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, গাড়িগুলো সরকারি ব্যবহারের জন্য ডিওটিতে হস্তান্তর করা হবে, যাতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু এখন শুল্ক ও ডেমারেজ পরিশোধের দাবিতে সেই প্রক্রিয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে ২৬টি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ও চারটি টয়োটা হ্যারিয়ার। এর মধ্যে ২০২৪ সালে জাপানে তৈরি ৩৩৪৬ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার জেডএক্স মডেলের ২৪টি একেবারে নতুন (ব্র্যান্ড নিউ) গাড়ি। প্রতিটির সংরক্ষিত মূল্য প্রায় ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
গাড়িগুলো আমদানি করেছিলেন তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য তারানা হালিম, মুহাম্মদ সাদিক, এ বি এম আনিসুজ্জামান, মজিবুর রহমান, জান্নাত আরা হেনরী, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সানজিদা খানম, এস এম কামাল হোসেন, মো. আসাদুজ্জামানসহ আরও কয়েকজন সাবেক এমপি।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, সংসদ সদস্যরা মেয়াদে থাকাকালে একটি গাড়ি শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করতে পারেন। তবে সংসদ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যদি গাড়িটি খালাস না হয়, তাহলে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেই সমস্যায় পড়েছেন এই সাবেক এমপিরা।
চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে থাকা এই ৩০টি গাড়ির কারণে প্রতিদিন ডেমারেজ বা বন্দরের অতিরিক্ত চার্জ বাড়ছে। কাস্টম হাউস জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এসব গাড়ির জন্য কয়েক কোটি টাকার বন্দর চার্জ বকেয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে গাড়িগুলোর সংরক্ষণ, নিরাপত্তা, এবং নিলাম ব্যর্থতার কারণে সরকারি রাজস্ব আদায়ও বন্ধ রয়েছে। যদি সরকার এই গাড়িগুলো সরকারি ব্যবহারে নিতে চায়, তাহলে কাস্টমসের দাবি করা ১৭৫ কোটি টাকার শুল্ক পরিশোধ করতে হবে, যা অনেকের মতে “অযৌক্তিক” হলেও আইনি বাধ্যবাধকতা হিসেবে রয়ে গেছে।
রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখানে প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাব প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। সাবেক এমপিদের গাড়ি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়ার আগে শুল্ক দায় মওকুফ করার উদ্যোগ নেওয়া যেত। এখন শুল্ক, বন্দর চার্জ এবং ডেমারেজ—সবকিছুর ভার সরকারকেই নিতে হবে।
বাংলাদেশ ট্যাক্সেশন ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন বলেন, “এই গাড়িগুলো রাষ্ট্রের জন্য রাজস্ব ক্ষতির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। হয় শুল্ক মওকুফ করে সরকারকে দ্রুত বাজেয়াপ্ত করতে হবে, নয়তো আইনি প্রক্রিয়ায় নিলামের ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘসূত্রিতা বাড়লে রাষ্ট্রই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সাবেক এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি বিলাসবহুল গাড়ি এখন সরকারের জন্য ‘রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বোঝা’য় পরিণত হয়েছে। একদিকে কাস্টমসের রাজস্ব দাবি, অন্যদিকে এনবিআরের স্থগিতাদেশ—দুইয়ের টানাপোড়েনে গাড়িগুলোর ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
চট্টগ্রাম বন্দরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কোটি টাকার এই ল্যান্ড ক্রুজারগুলো এখন দেশের আমলাতন্ত্রের জটিলতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সরকার কীভাবে এই জট খুলবে—তা এখন সময়ের অপেক্ষা।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



