ছবি: সংগৃহীত
দেশের রপ্তানি খাতে স্বল্পমেয়াদি মূলধন ঘাটতি দূর করতে এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে নতুন এক আর্থিক সুবিধা চালু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আয়ের বৈদেশিক মুদ্রা (যেমন মার্কিন ডলার, ইউরো, পাউন্ড বা ইয়েন) নগদে বিক্রি না করেই টাকার সুবিধা নিতে পারবেন ‘সোয়াপ’ চুক্তির মাধ্যমে। সোমবার (৩ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ থেকে জারি করা এক নির্দেশনায় দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে এই নতুন সুবিধা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই উদ্যোগকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা একদিকে রপ্তানিকারকদের স্বল্পমেয়াদি তারল্য সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করবে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ও বিনিময় হারের ওপর চাপ কমাবে।
‘সোয়াপ’ হলো একটি চুক্তি-ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা, যেখানে একজন রপ্তানিকারক সাময়িকভাবে তার বৈদেশিক মুদ্রা একটি ব্যাংকে হস্তান্তর করেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর তা ফেরত পান। এই সময়ের মধ্যে ব্যাংক তাকে সেই ডলারের সমমূল্যের টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রা) প্রদান করবে। মেয়াদ শেষে রপ্তানিকারক সেই টাকা ব্যাংকে ফেরত দিয়ে নিজের বৈদেশিক মুদ্রা পুনরুদ্ধার করবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এটি কোনো ঋণ বা দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নয়—বরং এক প্রকার “স্বল্পমেয়াদি বিনিময় চুক্তি”, যা মূলত ডলার ধরে রেখেও টাকার সুবিধা নেওয়ার একটি সহজ উপায়। এই সোয়াপের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৩০ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
রপ্তানিকারকরা তাদের ইআরকিউ (Exporters’ Retention Quota) বা পুল অ্যাকাউন্টের বিপরীতে এই সোয়াপ সুবিধা নিতে পারবেন। সাধারণত রপ্তানি আয়ের একটি অংশ রপ্তানিকারকরা বৈদেশিক মুদ্রায় নিজেদের অ্যাকাউন্টে রাখার অনুমতি পান, যা দিয়ে তারা আমদানি পণ্য, কাঁচামাল বা উৎপাদন উপকরণ কিনে থাকেন।
এই নতুন ব্যবস্থার আওতায় রপ্তানিকারকরা তাদের সেই ইআরকিউ অ্যাকাউন্টে থাকা ডলার বা অন্য মুদ্রা সাময়িকভাবে ব্যাংকে জমা রেখে তার সমমূল্যের টাকা ব্যবহার করতে পারবেন, যা পরবর্তীতে ফেরত দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এই লেনদেনের ক্ষেত্রে দুই মুদ্রার সুদের হার বা লাভজনকতার পার্থক্য বিবেচনায় “সোয়াপ পয়েন্ট” নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ, ব্যাংক ডলার ও টাকার মধ্যে সুদ ব্যবধান অনুযায়ী একটি সামান্য মুনাফা বা খরচ হিসাব করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—সোয়াপের মাধ্যমে পাওয়া টাকা শুধুমাত্র রপ্তানি কার্যক্রম-সংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে:
উৎপাদন ব্যয় নির্বাহ,
কাঁচামাল বা উপকরণ ক্রয়,
শ্রমিকের বেতন ও পরিবহন ব্যয়,
রপ্তানি পণ্যের প্যাকেজিং ও শিপমেন্ট খরচ।
অন্যদিকে, এই টাকার কোনো অংশ জল্পনামূলক লেনদেন (speculative trading), মুদ্রা বিনিয়োগ, বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যবসায় ব্যবহার করা যাবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে, এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই উদ্যোগ রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বড় স্বস্তি এনে দেবে। কারণ, আগে তারা নগদ টাকার প্রয়োজন মেটাতে রপ্তানি আয়ের ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হতেন, যা ডলার বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলত। এখন তারা সেই ডলার ধরে রেখেও টাকার সহায়তা নিতে পারবেন।
এর ফলে একদিকে রপ্তানিকারকরা তাদের পেমেন্ট ও উৎপাদন ব্যয় নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারবেন, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রয়োজনীয় চাহিদা কমবে। এতে বাজারে ডলারের দাম ও রিজার্ভের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক রপ্তানিকারক ডলারের ঘাটতি ও নগদ সংকটের মধ্যে পড়ে সময়মতো উৎপাদন ব্যয় চালাতে পারছেন না। সোয়াপ চুক্তি তাদের সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে এটি ডলার বিক্রির চাপ কমাবে, যা বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সব বাণিজ্যিক ব্যাংককে সোয়াপ চুক্তির প্রতিটি লেনদেন সঠিকভাবে রেকর্ড রাখতে এবং এর বিস্তারিত প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাতে বলেছে।
এছাড়া ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে যেন তারা সোয়াপের নামে কোনো ধরনের ঋণ সুবিধা বা সুদে ভিত্তিক আর্থিক লেনদেন চালু না করে। সোয়াপের মেয়াদ শেষে নির্ধারিত সময়ে পুরো লেনদেন নিষ্পত্তি করতে হবে, নইলে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতে অনিয়ম বলে গণ্য হবে।
বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী। কারণ, বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের সময় রপ্তানিকারকরা যেমন তারল্য সংকটে ভুগছেন, তেমনি ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভের ওপরও প্রভাব পড়ছে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, “এটি মূলত রপ্তানিকারকদের জন্য একটি ব্রিজ ফান্ডিং মডেল। এতে তাদের উৎপাদন ও লজিস্টিক ব্যয় নির্বাহের পথ সহজ হবে। একই সঙ্গে ডলার বিক্রির প্রবণতা কমবে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য ভালো খবর।”
অন্যদিকে বাণিজ্য বিশ্লেষক মো. মাহবুবুল আলম মনে করেন, “সোয়াপ সুবিধা আসলে এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক সেফটি নেট’। এটি রপ্তানিকারকদের মানসিক স্বস্তি দেবে। তারা জানবেন, জরুরি সময়ে ব্যাংকের সহায়তায় টাকার প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব।”
গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে আসছে এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান চাপে রয়েছে। রপ্তানিকারকরা তাদের আয় ব্যাংকে রাখলেও তাৎক্ষণিক টাকার প্রয়োজন মেটাতে পারছিলেন না, যার ফলে উৎপাদন ব্যয় ও পরিবহন ব্যয়ে বাধা তৈরি হচ্ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে সোয়াপ সুবিধা চালু করা হলো যেন রপ্তানিকারকরা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ধরে রেখে দেশীয় উৎপাদন ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন। এতে তারা একদিকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের নিরাপত্তা বজায় রাখতে পারবেন, অন্যদিকে দেশীয় অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহও অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন ‘সোয়াপ’ নীতি রপ্তানিখাতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি যেমন রপ্তানিকারকদের স্বল্পমেয়াদি মূলধন সংকট নিরসনে সহায়ক হবে, তেমনি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে স্থিতিশীলতাও আনবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে রপ্তানিকারকরা তাদের ডলার আগেভাগে বিক্রি না করেও উৎপাদন ব্যয় নির্বাহ করতে পারবেন, ব্যাংকগুলোর লেনদেন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে এবং দেশের অর্থনীতিতে তারল্য ব্যবস্থাপনা আরও দক্ষ হবে।
অন্যভাবে বললে—এই সোয়াপ উদ্যোগে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হলো: রপ্তানিকারক পেল স্বস্তি, ডলার বাজার পেল স্থিতি।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



