ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থার পর বিএনপি অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। সোমবার (৩ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন। তবে ৩০০টি আসনের মধ্যে ৬৩টি আসন এখনো খালি রাখা হয়েছে, যেখানে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়নি।
দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ৬৩ আসন ইচ্ছাকৃতভাবে এখনই ঘোষণা করা হয়নি—এগুলোতে কৌশলগত আলোচনা, জোটভিত্তিক সমন্বয়, এবং সম্ভাব্য প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই এখনো চলমান। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এই আসনগুলোর বেশ কয়েকটিতে এখনো বিএনপি জোটের সহযোগী দলগুলোর সঙ্গে আসন বিন্যাসের বিষয়ে আলোচনা চলছে। অন্যদিকে কিছু আসনে একাধিক প্রার্থীর মধ্যে যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা যাচাই-বাছাই করে ‘শেষ মুহূর্তে’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিকেল ৫টার দিকে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, “আজ আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে ২৩৭টি আসনের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করছি। এটা চূড়ান্ত নয়—আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং নির্বাচন পরিচালনা কমিটি মনে করলে যেকোনো সংশোধনী আনা হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি, সেগুলো নিয়ে আমরা এখনো আলোচনা করছি। কোথাও কোথাও জোটের অন্যান্য দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলছে, আবার কোথাও যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি বাকি আছে। সময়মতো সব আসনেরই নাম ঘোষণা করা হবে।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে), নজরুল ইসলাম খানসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। দলের নেতারা জানান, এবার প্রার্থী বাছাইয়ে জেলা পর্যায়ের তৃণমূল কমিটির মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি যে ৬৩টি আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি, সেগুলো হলো— ঠাকুরগাঁও-২, দিনাজপুর-৫, নীলফামারী-১ ও ৩, লালমনিরহাট-২, বগুড়া-২, নওগাঁ-৫, নাটোর-৩, সিরাজগঞ্জ-১, পাবনা-১, ঝিনাইদহ-১, ২ ও ৪, যশোর-৫, নড়াইল-২, বাগেরহাট-১, ২ ও ৩, খুলনা-১, পটুয়াখালী-২ ও ৩, বরিশাল-৩, ঝালকাঠি-১, পিরোজপুর-১, টাঙ্গাইল-৫, ময়মনসিংহ-৪ ও ১০, কিশোরগঞ্জ-১ ও ৫, মানিকগঞ্জ-১, মুন্সিগঞ্জ-৩, ঢাকা-৭, ৯, ১০, ১৩, ১৭, ১৮ ও ২০, গাজীপুর-১ ও ৬, নরসিংদী-৩, নারায়ণগঞ্জ-৪, রাজবাড়ী-২, ফরিদপুর-১, মাদারীপুর-২, সুনামগঞ্জ-২ ও ৪, সিলেট-৪ ও ৫, হবিগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৬, কুমিল্লা-২ ও ৭, লক্ষ্মীপুর-১ ও ৪, চট্টগ্রাম-৩, ৬, ৯, ১১, ১৪ ও ১৫, এবং কক্সবাজার-২।
দলীয় সূত্রের বরাতে জানা গেছে, এই আসনগুলোর বেশ কয়েকটিতে বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণফোরাম এবং কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে আলোচনাও চলছে। বিশেষ করে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি আসনে সহযোগী দলগুলোর অংশগ্রহণ নিয়ে সমন্বয় প্রয়োজন।
বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা জানিয়েছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই দলটি “ধাপে ধাপে প্রার্থী ঘোষণা”র কৌশল নিয়েছে। কারণ, একসঙ্গে সব আসনের প্রার্থী ঘোষণা করলে দলীয় বিরোধ ও অসন্তোষ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া, যেসব এলাকায় আঞ্চলিক প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে, সেসব জায়গায় স্থানীয় পর্যায়ের মতামত যাচাই করে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এটা বিএনপির দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনী কৌশলের অংশ। আমরা চাই, প্রার্থীদের মনোনয়ন যেন জনপ্রিয়তা, তৃণমূলের সমর্থন এবং রাজনৈতিক দক্ষতার ভিত্তিতে হয়। অনেক জায়গায় জোটের সমন্বয় এবং স্থানীয় বাস্তবতা যাচাই চলছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “খুলনা, ফরিদপুর, বগুড়া ও কক্সবাজারের কিছু আসনে ধর্মভিত্তিক ও আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়া করার প্রক্রিয়া চলছে। তাই এই আসনগুলো আপাতত খালি রাখা হয়েছে।”
দলীয় মহলে জানা গেছে, বিএনপি এবার প্রার্থী বাছাইয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের তৃণমূল নেতাদের মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। প্রতিটি বিভাগে গঠন করা হয়েছে “মনোনয়ন যাচাই কমিটি”, যারা প্রার্থীদের অতীত রেকর্ড, সাংগঠনিক যোগ্যতা, নির্বাচনী সম্ভাবনা এবং জনগণের গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়ন করছে।
বিএনপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “আমরা এবার শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা নয়, সততা ও সাংগঠনিক শক্তির ভিত্তিতেও প্রার্থী যাচাই করছি। হলফনামা, আয়ের উৎস এবং পূর্ববর্তী নির্বাচনের রেকর্ডও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।”
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও গণফোরামসহ আরও কয়েকটি দল। জোটের অংশীদারদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে জামায়াতের প্রার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করেই বিএনপি তাদের চূড়ান্ত তালিকা দিতে চায়।
একজন জোট সমন্বয়ক বলেন, “জামায়াত ও বিএনপি উভয়ই চাইছে, এক আসনে একাধিক প্রার্থী না থাকে। তাই কিছু আসনে যৌথ প্রার্থী নির্ধারণের আলোচনা চলছে। এছাড়া, ছোট দলগুলো যেসব আসনে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী, সেখানে বিএনপি আপাতত প্রার্থী ঘোষণা করেনি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপির এই ধীরে ধীরে প্রার্থী ঘোষণা আসলে “কৌশলগত নমনীয়তা বজায় রাখার” অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রেজা বলেন, “বিএনপি বুঝতে পারছে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সমীকরণ যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে। তাই তারা এমন অবস্থান নিয়েছে যাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দরজা খোলা থাকে—যেন সম্ভাব্য জোট পরিবর্তন বা সমঝোতার ক্ষেত্রে কোনো বাধা না আসে।”
তিনি আরও বলেন, “এটা একদিকে দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য রক্ষার কৌশল, অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে মানিয়ে চলারও উপায়।”
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যে সরগরম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকার নির্বাচন প্রস্তুতি শুরু করেছে, আর বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি সবচেয়ে আগে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে মাঠে নেমেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই নির্বাচনে বিএনপির পারফরম্যান্স অনেকটাই নির্ভর করবে তারা কীভাবে জোটের ভেতরে সমন্বয় বজায় রাখে এবং খালি রাখা আসনগুলোতে কোন ধরনের প্রার্থী মনোনয়ন দেয় তার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
				.png)
.png)
.png)



