ছবি: সংগৃহীত
আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ দেশ সুদান দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে পুড়ছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের আগুনে। সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-এর ক্ষমতার লড়াই এখন দেশটিকে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সুদান আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটের মুখোমুখি।
২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া সংঘাতে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে দেড় লাখের বেশি মানুষ।
খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ ও সহিংসতার কারণে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ। পশ্চিম দারফুর অঞ্চলের এল-ফাশের শহর দখলের পর আরএসএফ বাহিনীর হাতে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলেও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অভিযোগ।
সুদানের অবস্থান কৌশলগতভাবে কেন গুরুত্বপূর্ণ
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার বিশাল এই দেশটির আয়তন প্রায় ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার। সাতটি দেশের সঙ্গে সীমান্তের পাশাপাশি লোহিত সাগরের উপকূল থাকায় সুদান কৌশলগত দিক থেকে বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নীল নদ এই দেশটির মধ্য দিয়েই প্রবাহিত।
সুদানের জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলিম, ভাষা আরবি ও ইংরেজি।
যুদ্ধের আগেই বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ছিল সুদান, যদিও এটি আফ্রিকার শীর্ষ স্বর্ণ উৎপাদকদের অন্যতম। সুদানের ৪ কোটি ৬০ লাখ নাগরিকের গড় বার্ষিক আয় সাড়ে ৭০০ ডলারেরও কম।
চলমান সংঘাত দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংসের আরো কাছে ঠেলে দিয়েছে। সরকারি আয় কমে গেছে প্রায় ৮০ শতাংশ।
গৃহযুদ্ধের শিকড় : ক্ষমতার লড়াই
বর্তমান গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ২০১৯ সালে, যখন ৩০ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে গণবিক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনী সরিয়ে দেয়। এরপর সেনা ও বেসামরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও ২০২১ সালে আরেকটি অভ্যুত্থানে তা ভেঙে পড়ে।
এই অভ্যুত্থানের দুই মূল নায়কই আজ পরস্পরের শত্রু—সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং আরএসএফ প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি ‘হেমেডটি’ নামে পরিচিত।
প্রথমে তারা একসঙ্গে আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পরে ক্ষমতার ভাগাভাগি এবং বেসামরিক শাসনে ফেরার প্রশ্নে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। আরএসএফ বাহিনীর প্রায় এক লাখ সদস্যকে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা এবং কে নেতৃত্ব দেবেন—এই ইস্যুই মূল সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
অবশেষে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। অল্প সময়েই আরএসএফ রাজধানী খার্তুমের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী ২০২৫ সালের মে মাসে খার্তুম পুনর্দখল করে।
কে এই আরএসএফ? কিভাবে অস্ত্র-অর্থ পাচ্ছে?
র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস মূলত ২০১৩ সালে গঠিত হয়। এর শিকড় দারফুরের কুখ্যাত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া, যারা বিদ্রোহীদের দমনে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। সেই সময় এই বাহিনীকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির।
এদিকে সুদানের সামরিক সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ করেছে, যা আমিরাত অস্বীকার করেছে। এপ্রিলে ফাঁস হওয়া জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের একটি রিপোর্টে ‘একাধিক’ আমিরাতি ফ্লাইটের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিবহন বিমানগুলো দারফুরে সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করা হয় এমন চাদের ঘাঁটিগুলোতে উড়ে যাওয়ার সময় শনাক্ত হওয়া এড়াতে ইচ্ছাকৃত চেষ্টা করেছিল বলে মনে করা হয়।
আরএসএফের সঙ্গে আমিরাতের সম্পর্ক ২০১৫ সালের ইয়েমেন যুদ্ধ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে আরএসএফকে সৌদি এবং আমিরাতি বাহিনীর পক্ষে লড়াই করার জন্য ইয়েমেনে যোদ্ধা নিয়োগ করতে ব্যবহার করা হয়েছিল। সুদানে আমিরাতের আগ্রহের কারণ হলো এর সোনা, যার বেশিরভাগই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমিরাতে চলে গেছে।
বর্তমানে আরএসএফ দারফুর ও কোর্দোফান অঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা দখলে নিয়ে নিজেদের ‘স্বাধীন প্রশাসন’ দাবি করছে। ফলে সুদান আবারও বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে আলাদা দেশ হিসেবে দক্ষিণ সুদান আত্মপ্রকাশ করেছিল।
সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কোথায়?
সুদানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ এলাকা এখন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। তাদের পাশে রয়েছে প্রতিবেশী মিশর, যার সঙ্গে সুদানের নীল নদভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর।
জেনারেল বুরহান লোহিত সাগর উপকূলের পোর্ট সুদান শহরকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করেছেন। তবে সেখানেও নিরাপত্তা নেই—আরএসএফ সম্প্রতি শহরটিতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে।
মার্চেই আরএসএফের হাত থেকে দারফুর শহর পুনর্দখল করে সেনাবাহিনী। যদিও সেনাবাহিনী যখন দারফুরের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়, তখন শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এর কিছুদিনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গেজিরাও সেনাবাহিনী দখলে নেয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষদিকে দারফুরের শহরাঞ্চল এল-ফাশের আরেএসএফ সেনাদের দখলে যাওয়াকে সেনাবাহিনীর বড় পরাজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দারফুরে গণহত্যার অভিযোগ
জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, আরএসএফ ও তাদের সহযোগী আরব মিলিশিয়ারা দারফুরে জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা চালাচ্ছে। অ-আরব গোষ্ঠীর নারীদের ওপর ব্যাপক ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। এমনকি এক বছরের শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার ঘটনাও নথিবদ্ধ হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মার্চ মাসে মাসালিট ও অন্যান্য অ-আরব জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরএসএফের অভিযান গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছেছে। জাতিসংঘের তদন্তে সেনাবাহিনীকেও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা জানিয়েছেন যে তাদের কাছে এমন বক্তব্যও রয়েছে যে আরএসএফ সেনারা যৌন আক্রমণ করার সময় অনারব নারীদের উদ্দেশ্য করে এমন মন্তব্য করেছেন যে তাদের গর্ভে জোরপূর্বক ‘আরব সন্তান’ দেওয়া হবে।
এল-ফাশের শহরের দখল নেওয়ার পর দারফুরে এখন প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মৃত্যুভয়ে আশ্রয়হীন। আন্তর্জাতিক মহল আশঙ্কা করছে, বর্তমান গতিপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে সুদান দ্বিতীয়বারের মতো ভেঙে পড়তে পারে—আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়বে আফ্রিকার একটি জাতির ভবিষ্যৎ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



