ছবি: সংগৃহীত
আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সুদানের উত্তর দারফুর রাজ্যের রাজধানী এল-ফাশের (El-Fasher) শহরে এখন মৃত্যুর নীরব রাজত্ব। শহরের রাস্তায় পড়ে আছে শত শত বেসামরিক মানুষের লাশ—অনেকের দেহ ইতিমধ্যে পচে গেছে, দুর্গন্ধে ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। কেউ কবর দিতে আসছে না, কারণ জীবিত যারা বেঁচে আছেন, তাদেরও প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পালাতে হচ্ছে দিকবিদিক ছুটে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই শহর এখন ‘মৃত্যুর উপত্যকা’তে পরিণত হয়েছে।
গত সপ্তাহে সুদানের আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) এল-ফাশের শহরটি দখল করে নেয়। তাদের এ অভিযানে অন্তত ১,৫০০ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র ও জাতিসংঘ। নিহতদের মধ্যে নারী, শিশু, বৃদ্ধ—সবাই রয়েছেন। কেবল শহরের একটি বড় হাসপাতালেই মারা গেছেন ৪৬০ জনেরও বেশি। হাসপাতালটির ভবন আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং আহতরা সেখানে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছেন কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা ছাড়া।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, শহরটিতে এখনো হাজারো বেসামরিক নাগরিক আটকা পড়ে আছেন। খাদ্য, পানি, ওষুধ—কিছুই নেই। প্রতিদিন বাড়ছে মৃতের সংখ্যা, এবং রাস্তায় লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অনেক এলাকাই পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
এক প্রত্যক্ষদর্শী নারী, হায়াত, আল জাজিরাকে জানিয়েছেন, “সাতজন আরএসএফ সদস্য আমাদের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট চালায়। তারা আমার ১৬ বছর বয়সি ছেলেকে আমার সামনেই গুলি করে মেরে ফেলে। রাস্তায় শত শত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। কেউ উদ্ধার করতে আসেনি, সবাই পালাচ্ছে নিজের জীবন বাঁচাতে।”
আরেকজন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি, হুসেইন, বলেছেন, “এল-ফাশের এখন এক ভুতুড়ে নগরী। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে, শকুন ও কুকুরগুলো দেহ টেনে নিচ্ছে। কবর দেওয়ার মতো লোক নেই, আর যারা আছে তারা নিজেরাই পালিয়ে যাচ্ছে।”
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ৩৬ হাজার মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারা ৭০ কিলোমিটার দূরের তাভিলা শহরের দিকে যাচ্ছে, যেখানে ইতিমধ্যে ৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু নতুন আসা লোকজনের জন্য জায়গা নেই, খাবার নেই, পানি নেই।
নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, “যারা এল-ফাশের থেকে পালাতে শুরু করেছিলেন, তাদের অনেকেই পথেই মারা গেছেন। গরম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা—সবকিছু মিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ। বেঁচে ফেরা অনেকেই শিশুদের হারিয়ে ফেলেছেন, কেউ আবার নিজের পরিবারকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না।”
জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানিয়েছেন, দারফুরে ত্রাণ কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা অনুমোদন করা হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, সহায়তা পৌঁছানো এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, কারণ এল-ফাশের শহরটি সম্পূর্ণভাবে আরএসএফ নিয়ন্ত্রণে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা ৪৫০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। তাদের মধ্যে রোগী, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাধারণ মানুষ ছিলেন। হাসপাতালগুলোতেও কোনো নিরাপত্তা নেই।”
সুদান বিশেষজ্ঞ শায়না লুইস আল জাজিরাকে বলেন, “দারফুরে এখন যা ঘটছে, তা একেবারে গণহত্যার পর্যায়ে। আমরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করে আসছি—বলেছিলাম, এখানে বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ হতে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ গুরুত্ব দেয়নি।”
তিনি আরও জানান, স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণেও দেখা যাচ্ছে, বিস্তীর্ণ এলাকা রক্তে রাঙা হয়ে গেছে। অনেক স্থানে মৃতদেহের সারি এত দীর্ঘ যে, সেগুলো মহাকাশ থেকেও দৃশ্যমান।
মানবিক সংগঠনগুলো সতর্ক করছে, এল-ফাশের এখন “সুদানের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহর”। খাদ্য, পানি ও ওষুধের ঘাটতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। লুটপাটের কারণে অনেক সাহায্যপণ্য পৌঁছাতে পারছে না। মৃতদেহ পচে ছড়াচ্ছে রোগের আশঙ্কা, যা মহামারি রূপ নিতে পারে।
তাভিলা ও আশপাশের শরণার্থী শিবিরগুলোতেও অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে এক শিশুর হাতে এক টুকরো রুটি ভাগ হয়ে যাচ্ছে পাঁচজনের মধ্যে। রোগে আক্রান্তদের কোনো চিকিৎসা নেই, আর আকাশজুড়ে ভাসছে ধোঁয়া ও মৃত্যুর গন্ধ।
একসময় যে এল-ফাশের ছিল দারফুরের ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র, আজ সেটিই পরিণত হয়েছে এক জনশূন্য নগরে—যেখানে কেবল পচে যাওয়া দেহ, ধ্বংসস্তূপ আর নীরব আর্তনাদ। মানবাধিকার কর্মীদের ভাষায়, “দারফুরে এখন মৃত্যু কেবল সংখ্যায় মাপা যায় না, এটি এক জাতির বিলুপ্তির ইতিহাস।”
সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



