 
					ছবি: সংগৃহীত
ভারতের বহুজাতিক শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে ভয়াবহ অনিয়ম, আর্থিক ফাঁকি ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার তথ্য রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের পর একের পর এক প্রকাশ পাচ্ছে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই এক চুক্তিতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্তত ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে—যা টাকার মূল্যে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকারও বেশি।
এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদানি গ্রুপের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তির পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী এই সংস্থা চুক্তির আর্থিক, প্রশাসনিক ও আইনগত দিক বিশ্লেষণের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
দুদকের উপ-পরিচালক আল-আমিন এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে আরও আছেন উপ-পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন ও সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান। তারা তিনজনই সরকারি প্রকিউরমেন্ট ও উচ্চমূল্যের আন্তর্জাতিক চুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “এই কমিটি আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিটি আর্থিক, আইনগত ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে পর্যালোচনা করবে। চুক্তির কাঠামো, শুল্ক ফাঁকির ধরন, কর অব্যাহতির বৈধতা, এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া যাচাই করা হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী কোনো ধারা বা অনিয়ম থাকলে তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হবে।”
দুদকের এই কমিটিকে ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে সময়সীমা বাড়ানো যেতে পারে, তবে প্রাথমিক অনুসন্ধানেই যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলে, তাহলে দুদক সরাসরি ফৌজদারি তদন্তে যেতে পারবে।
২০২৩ সালের ৯ মার্চ ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় স্থাপিত আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। ২৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তির আওতায় আদানির কেন্দ্র থেকে ১,৬০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ আমদানির কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিদ্যুৎ আমদানির সময় আদানিকে শুল্ক ও কর থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল পিডিবির অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই।
প্রতিবেদনে বলা হয়— ২০২৩ সাল থেকে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সময় কোনো আমদানি শুল্ক, ভ্যাট বা কর প্রদান করা হয়নি। এনবিআর বা বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদন না নিয়েই পিডিবি একতরফাভাবে শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
শুল্ক গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “বিদ্যুৎ প্রবেশের সময় কোনো প্রকার কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স করা হয়নি। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের হিসাবেও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন বা ইলেকট্রনিক ডেটা এন্ট্রি অনুপস্থিত। শুল্ক ফাঁকির এই প্রক্রিয়া নিয়মবহির্ভূত এবং তা দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের আর্থিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করেছে।”
শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের হিসেবে, ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির গড্ডা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ মোট ১,০৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৯০ হাজার ৮৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ আমদানি করেছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ৪৪২ ডলার।
এই আমদানিতে ৩১ শতাংশ শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর মিলিয়ে প্রায় ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলার রাজস্ব পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আদানিকে করমুক্ত সুবিধা দেওয়ায় তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়েনি।
বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, “এটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনিয়ম, যেখানে সরকারি সংস্থার ভেতর থেকেই অবৈধ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।”
শুল্ক গোয়েন্দা রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, আদানি-পিডিবি চুক্তি সম্পাদনের সময় ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ এর আওতায় স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন দেখানো হলেও, আসলে অনেক ধারা ও নিয়ম উপেক্ষা করা হয়েছিল।
এই আইনের আওতায় করা চুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিরীক্ষা ও সংসদীয় অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থগিত থাকে, যা আদানির মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বড় সুবিধা হিসেবে কাজ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে এই আইনের আওতায় সম্পাদিত সব চুক্তি—মোট ১১টি বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি—পুনর্বিবেচনার জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটিই আদানি চুক্তি তদন্তের সঙ্গে দুদকের সমন্বয়ে কাজ করবে বলে জানা গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানি গ্রুপ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে লাভজনক বিদেশি অংশীদার হয়ে উঠেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গৌতম আদানির প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি রাজনৈতিকভাবেও সংবেদনশীল ছিল।
সেই সময় আদানি চুক্তি নিয়ে সংসদে কিংবা সরকারের অভ্যন্তরেও কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। বরং পিডিবি, জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অজুহাতে সব দায় পরস্পরের ওপর চাপানো হয়েছিল।
রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের পর এখন অনেক নথি, চিঠি ও অনুমোদনপত্র বেরিয়ে আসছে, যা প্রমাণ করছে—এই চুক্তি শুধু আর্থিক নয়, প্রশাসনিক ও কূটনৈতিক স্বার্থে গঠিত একটি বিতর্কিত চুক্তি ছিল।
দুদকের নবগঠিত কমিটি এই চুক্তির অর্থপ্রবাহ, করফাঁকি, প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়া, এবং সম্ভাব্য স্বার্থসংঘাত বিশ্লেষণ করবে।
তারা এনবিআর, পিডিবি, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে যৌথভাবে নথিপত্র যাচাই করবে। প্রাথমিকভাবে ৪৫ দিনের মধ্যে একটি ইন্টারিম রিপোর্ট এবং পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ফাইনাল নিরীক্ষা রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
যদি চুক্তির কোনো ধারা রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী প্রমাণিত হয়, তাহলে দুদক শুধু অনিয়মের মামলা নয়, চুক্তি বাতিলের সুপারিশও করতে পারবে।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তির ইতিহাসে এই তদন্ত সবচেয়ে বড় নজির হতে পারে। কারণ এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম সিদ্ধান্তে বিদেশি প্রভাবের প্রশ্নও উত্থাপন করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, “আদানির মতো বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে এভাবে অস্বচ্ছ চুক্তি করা মানে রাষ্ট্রের নিজস্ব জ্বালানি নীতিকে পরনির্ভরতার দিকে ঠেলে দেওয়া।”
রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের পর এখন আশা করা হচ্ছে—দুদক সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করলে এই তদন্ত দেশের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির নতুন অধ্যায় সূচনা করতে পারে।
সংক্ষেপে:, আদানি-পিডিবি চুক্তিতে শুল্ক ফাঁকি, অনুমোদনবিহীন কর অব্যাহতি, আর্থিক অনিয়ম ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী ধারা—সবকিছু মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় দুর্নীতির নজিরে পরিণত হচ্ছে। দুদকের পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা এই রহস্যময় চুক্তির পেছনের আসল প্রভাব, প্রাপক ও প্রণোদনাগুলো উন্মোচন করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
 
				.png)
.png)
.png)



