 
					ছবি: সংগৃহীত
ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে রহস্যজনকভাবে অপহৃত কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল আহাদের জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটল ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। অজ্ঞাত পরিচয়ে উদ্ধার হওয়া এক ব্যক্তির মরদেহের পকেট থেকে পাওয়া একটি ব্যাংক চেক খুলে দেয় এক হারিয়ে যাওয়া মানুষের মৃত্যুর গোপন অধ্যায়।
ফেনী জেলা পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য—যে ব্যক্তিকে স্থানীয়রা অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, তিনি আর কেউ নন, ছয় বছর ধরে নিখোঁজ থাকা চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তা আবদুল আহাদ। এই ঘটনাকে ঘিরে নতুন করে আলোচনায় এসেছে ২০১৯ সালের সেই অপহরণ রহস্য, যা বহু বছর ধরে অনিশ্চয়তায় ঝুলে ছিল।
ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের সামনে বুধবার (২৯ অক্টোবর) সকালে স্থানীয়রা এক অচেতন ব্যক্তিকে পড়ে থাকতে দেখে। তারা দ্রুত তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।
খবর পেয়ে ছাগলনাইয়া থানা পুলিশের ওসি মো. আবুল বাশারের নেতৃত্বে একটি দল হাসপাতালে যায়। মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করতে পুলিশ তার সঙ্গে থাকা কাগজপত্র ও সামগ্রী পরীক্ষা শুরু করে। তল্লাশির এক পর্যায়ে তার পকেট থেকে উত্তরা ব্যাংকের ফেনী বিরিঞ্চি শাখার একটি চেক পাওয়া যায়, যেখানে অ্যাকাউন্টধারীর নাম লেখা ছিল ‘আবদুল আহাদ’।
প্রথমে বিষয়টি সাধারণ মনে হলেও, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাচাইয়ের পর চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানায়, ওই হিসাবের মালিক চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তা আবদুল আহাদ, যিনি ছয় বছর আগে হঠাৎ নিখোঁজ হয়েছিলেন।
এই পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই পুরো এলাকায় আলোচনা শুরু হয়—চট্টগ্রাম থেকে অপহৃত একজন সরকারি কর্মকর্তা ফেনীতে এলেন কীভাবে? কবে তিনি এখানে আসেন? কে বা কারা তাকে হত্যা করল?
নিহত আবদুল আহাদের ছোট বোন নাঈমা নাসরিন মনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “আমার ভাই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী মানুষ। সিলেটের ব্রিটানিকা উইমেন্স কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কাস্টমসের অডিটর পদে যোগ দিয়ে প্রথমে সিলেট, এরপর ঢাকা ও সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দায়িত্ব পালন করতেন।”
তিনি স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “২০১৯ সালের ১ মে হঠাৎ ভাইয়ের ফোন বন্ধ পাই। এরপর অচেনা একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। বলা হয়, ভাইকে অপহরণ করা হয়েছে, বিকাশে দুই লাখ টাকা পাঠালে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে ভয় পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠাই। কিন্তু এরপর আর যোগাযোগ করা যায়নি।”
“আমরা থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলাম, বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেছি, মিডিয়ায় খবরও দিয়েছিলাম। কিন্তু ছয় বছর ধরে কোনো খোঁজ পাইনি। অবশেষে ফেসবুকে এক পোস্টে জানতে পারি, ফেনীতে এক ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া গেছে—যার নাম আবদুল আহাদ। পরে ব্যাংক তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হই, সেটি আমার ভাইয়েরই মরদেহ।”
কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে তিনি বলেন, “আমরা শুধু জানতে চাই, কেন? কে বা কারা আমার ভাইকে এমন পরিণতি দিল? তিনি যদি বেঁচে থাকতেন, আজ হয়তো আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতেন।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহতের দেহে কোনো বড় আঘাতের চিহ্ন ছিল না, তবে মুখমণ্ডল ও বাহুতে হালকা দাগ দেখা গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাকে অজ্ঞান করার পর কোথাও ফেলে রাখা হয় অথবা বিষপ্রয়োগের শিকার হতে পারেন।
চেক পাওয়ার পর ফেনীর উত্তরা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই হিসাবটি সম্প্রতি খোলা হয়েছিল। এতে খুব অল্প পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তকারীরা এখন খতিয়ে দেখছেন, কে বা কারা তাকে ফেনীতে এনে অ্যাকাউন্ট খুলতে সহায়তা করেছিল এবং কেন তিনি এখানে অবস্থান করছিলেন।
ছাগলনাইয়া থানার ওসি মো. আবুল বাশার বলেন, “মরদেহ উদ্ধারের পর আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পরিচয় নিশ্চিত করতে চেকটি ব্যবহার করি। ব্যাংক তথ্য অনুযায়ী নিহত ব্যক্তি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার হাজীপুর ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের ইমানী মিয়ার ছেলে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পরই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে।”
তিনি আরও জানান, পুলিশ এখন নিহতের সাম্প্রতিক যোগাযোগ, ব্যাংক লেনদেন ও মোবাইল কল রেকর্ড খতিয়ে দেখছে।
২০১৯ সালের মে মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল আহাদ নিখোঁজ হওয়ার পর তার পরিবার কুলাউড়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিল। পরে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশও একটি অনুসন্ধান অভিযান চালায়। তবে কোনো সূত্র না পাওয়ায় মামলা কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।
তখন স্থানীয়ভাবে গুজব ছড়িয়েছিল, কিছু সিন্ডিকেটভুক্ত দালাল ও চোরাচালানচক্রের সঙ্গে কাস্টমস কর্মকর্তার বিরোধের জেরেই অপহরণের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থা সেই অভিযোগের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি।
একজন অবসরপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, “আহাদ ছিলেন সৎ ও নীতিবান অফিসার। এমন মানুষ শত্রু তৈরি করতে পারেন, কিন্তু আইনভঙ্গ করেননি কখনো। তার অপহরণ এবং এখন মরদেহের খোঁজ পাওয়া—এটি খুবই মর্মান্তিক।”
ফেনী সদর হাসপাতালের মর্গে আবদুল আহাদের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর আগে তিনি অজ্ঞান করার মতো কোনো পদার্থ গ্রহণ করেছিলেন কিনা তা জানতে টক্সিকোলজি পরীক্ষা করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, তদন্তের পরই বোঝা যাবে এটি হত্যাকাণ্ড, আত্মহত্যা নাকি অন্য কোনো অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ফল।
এই ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে লিখছেন, ছয় বছর ধরে একটি সরকারি কর্মকর্তা নিখোঁজ থাকলেও তদন্তের অগ্রগতি হয়নি—এটি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
একজন সাবেক সহকর্মী লিখেছেন, “আমরা ভেবেছিলাম আহাদ কোথাও আছেন, একদিন ফিরে আসবেন। কিন্তু এমন মৃত্যুর সংবাদ কোনো পরিবারের সহ্য করার নয়।”
চট্টগ্রাম থেকে অপহৃত হয়ে ছয় বছর পর ফেনীতে মরদেহ হয়ে ফেরা কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল আহাদের ঘটনা এখন একটি রহস্যময় ক্রাইম স্টোরি। পুলিশ বলছে, সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে শিগগিরই বিস্তারিত জানানো হবে।
কিন্তু পরিবারের কাছে এটি শুধুই এক প্রশ্ন—দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার পরও কেন তারা প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পেল না?
বাংলাবার্তা/এসজে
 
				.png)
.png)
.png)



