ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সর্ববৃহৎ আঞ্চলিক সংগঠন আসিয়ানের (ASEAN) সাম্প্রতিক সম্মেলনে বিশ্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে গভীর আলোচনা হলেও, মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম বৃহৎ অধ্যায়—রোহিঙ্গা সংকট—একেবারেই গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের জন্য এটি যেমন গভীর হতাশার, তেমনি আঞ্চলিক মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিফলনও।
গত ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত হয় এবারের আসিয়ান সম্মেলন। তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ নেতারা—যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রাজিল, কানাডা ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ নানা দেশের প্রতিনিধি। পাশাপাশি অংশ নেন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইএলও ও ফিফার মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানরাও।
সম্মেলনের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায় কারণ এতে অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে এক ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির সাক্ষী ছিলেন। এই ঘটনাটি সম্মেলনের আলোচনায় প্রাধান্য পেলেও, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যা ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ কোনো আলোচনাতেই স্থান পায়নি।
এবারের আসিয়ান সম্মেলনে তিমুর-লেস্তেকে নতুন সদস্য দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হালনাগাদসহ বেশ কিছু অর্থনৈতিক সমঝোতা হয়, যার লক্ষ্য আসিয়ানকে বৈশ্বিক মূল্যশৃঙ্খলে (Global Value Chain) আরও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দেওয়া। আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সীমান্ত উত্তেজনা, সামুদ্রিক বিরোধ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা—সবই আলোচনায় ছিল।
কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট—যা একদিকে মানবিক বিপর্যয়, অন্যদিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি—সেটি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত থাকে।
আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল কাউন্সিলের (ARNC) সহ-সভাপতি নেই সান লুইন জার্মানি থেকে বলেন, “এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। আসিয়ান সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যু উপেক্ষিত মানে হলো, তারা মানবাধিকারের মৌলিক প্রশ্নগুলোকেই এড়িয়ে যাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “সবাই শুধু ট্রাম্প কী বলছেন, কোন বাণিজ্যচুক্তি হচ্ছে—এসব নিয়েই ব্যস্ত ছিল। কিন্তু কেউ রোহিঙ্গাদের কথা ভাবেনি। রোহিঙ্গারা কি মানুষ নয়? তারা কি মর্যাদার সঙ্গে ও মৌলিক অধিকার নিয়ে বাঁচার অধিকার রাখে না?”
সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বর্জন
যদিও একটি ইতিবাচক দিক ছিল—মিয়ানমারের জান্তা সরকারের প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং-কে এ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আসিয়ান জান্তা সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিরূপ মনোভাবের ইঙ্গিত দিলেও, বাস্তব পদক্ষেপের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
নেই সান লুইন বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট নতুন কিছু নয়। এটি দীর্ঘদিনের, গভীর এক মানবিক বিপর্যয়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, বিশ্বনেতারা একে ভুলে যাচ্ছেন। তাদের কাছে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক স্বার্থই যেন সব।”
২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর দমন অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে আবারও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘর্ষে নতুন করে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়।
জাতিসংঘের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে মিয়ানমারে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ গৃহহীন বা বাস্তুচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে জান্তা সরকারের দমননীতি ও চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে হাজারো মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এখন প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রিত। তাদের জন্য চলতি বছর ৯৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার চাহিদা ছিল, কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৮ শতাংশ তহবিল দিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ভয়াবহ খাদ্যসংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আসিয়ান সম্মেলনের শেষে প্রকাশিত চার পৃষ্ঠার ঘোষণায় ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি একবারও উল্লেখ করা হয়নি। এই বিষয়ে আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (APHR)-এর সহ-সভাপতি চার্লস সান্তিয়াগো তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “এর মানে হলো আসিয়ান রোহিঙ্গা সংকটকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেই দেখছে। অথচ এর প্রভাব পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া জুড়ে পড়ছে—বিশেষত বাংলাদেশে।”
তিনি বলেন, “আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আসিয়ানের উচিত এই সংকট মোকাবিলায় দায়িত্ব নেওয়া। একটি গণহত্যা ঘটে যাচ্ছে তাদের সদস্য রাষ্ট্রে—তারা তা উপেক্ষা করতে পারে না।”
মিয়ানমারের সামরিক সরকার ডিসেম্বর মাসে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সান্তিয়াগো আশঙ্কা প্রকাশ করেন, “আসিয়ান সম্ভবত জান্তা সরকারের এই নির্বাচনী নাটককে স্বীকৃতি দেবে। অথচ জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে—গৃহযুদ্ধ চলাকালে এ নির্বাচন হবে প্রহসনমূলক। তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না।”
সান্তিয়াগোর মতে, “এই অবস্থায় আসিয়ানের নীরবতা শুধু রোহিঙ্গাদের নয়, বরং মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকেও ধ্বংস করছে। সংগঠনটি যদি শুধু অর্থনীতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তাহলে মানবাধিকারের প্রতি তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বলছে, আসিয়ান যদি সত্যিই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা চায়, তবে তাদের উচিত হবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরাসরি ভূমিকা নেওয়া, মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা, এবং শরণার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা।
সান্তিয়াগো শেষ পর্যন্ত আহ্বান জানান— “আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শুধু কথায় নয়, বাস্তব পদক্ষেপে দেখাতে হবে যে তারা মানবিকতার পক্ষে আছে। রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের অন্যান্য নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হবে, এবং যারা গণহত্যা ঘটাচ্ছে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।”
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক সংহতির প্রশ্নে রোহিঙ্গা সংকট এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। কিন্তু বিশ্বনেতাদের অবহেলা ও আসিয়ানের নীরবতা শুধু বাংলাদেশের ওপরই নয়, পুরো অঞ্চলের মানবিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রোহিঙ্গা সংকট তাই আজ শুধু একটি শরণার্থী ইস্যু নয়—এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানবিকতা ও নৈতিক দায়িত্বের পরীক্ষার ক্ষেত্র।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



