ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ পুলিশের ভেতরে দীর্ঘদিনের পদোন্নতি বঞ্চনার ক্ষোভ এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যেখানে বহু কর্মকর্তা মনে করেছিলেন নতুন সরকারের আমলে ন্যায্য মূল্যায়ন হবে, সেখানে সময় গড়ালেও তাদের ভাগ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। চারটি ব্যাচ—১৫, ১৬, ১৮ ও ২০তম বিসিএসের শতাধিক কর্মকর্তা এখনো তাদের প্রাপ্য পদে উন্নীত হতে পারেননি। এ নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে অসন্তোষ ও হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের একটানা শাসনামলে পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যই ছিল মূল বিবেচ্য। ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড বা দলীয় প্রভাব না থাকলে অনেক মেধাবী কর্মকর্তাকেও বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। কিছু কর্মকর্তাকে মিথ্যা ও কাল্পনিক অভিযোগে ওএসডি করা হয়, আবার কেউ নির্বাসিত জীবন কাটান প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কারও পোস্টিং হয় এমন স্টেশনে, যেখানে সাধারণত লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়।
অনেকে পরিবারের দায়িত্ব সামলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে বেঁচে আছেন। কেউ কেউ আন্তর্জাতিক মিশনে পাঠানোর অপেক্ষায় থেকেও সুযোগ পাননি। এমনকি বঞ্চনার চাপ ও মানসিক কষ্টে মৃত্যুবরণ করেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা।
সরকারের শেষ কয়েক বছরে জ্যেষ্ঠতা ও মেধার পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়ার একাধিক উদাহরণ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, ২০২২ সালে শেখ হাসিনা সরকার ২০তম বিসিএস ব্যাচের ১৬ জন কর্মকর্তাকে সরাসরি ডিআইজি পদে পদোন্নতি দেয়। এতে জ্যেষ্ঠ ১৫, ১৬ ও ১৮ ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা উপেক্ষিত হন। সেই তালিকায় ছিলেন আলোচিত ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ ও তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বিপ্লব সরকারও।
এই ঘটনার পর থেকেই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তাদের অভিযোগ, “মেধা ও যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যই ছিল মূল মাপকাঠি।”
এই বঞ্চিতদের মধ্যে অন্যতম ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান—১৫তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা, যিনি শেখ হাসিনা সরকারের সময় দুবার চাকরি হারান। আদালতের নির্দেশে একবার ফিরে এলেও ২০২২ সালে দ্বিতীয় দফায় তাকে এসপি পদ থেকেই চাকরিচ্যুত করা হয়। তার অপরাধ—“সরকারের অন্যায় আদেশ না মানা” ও “দুর্নীতি-গুম-খুনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া।”
৫ আগস্টের ক্ষমতাবদলের পর নতুন সরকার তাকে ডিআইজি পদে উন্নীত করলেও, ব্যাচমেটদের তুলনায় তিনি এখনও পদোন্নতিতে অনেক পিছিয়ে। তার অনেক সহকর্মী ইতিমধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি পদেও চলে গেছেন। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মতে, জিল্লুর রহমানের মতো উদাহরণই প্রমাণ করে, দলীয় পরিচয়ই ছিল পদোন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি।
২০তম ব্যাচের প্রথম স্থান অর্জনকারী কর্মকর্তা আশিক সাঈদকেও শেখ হাসিনা সরকারের সময় “জামায়াত-শিবির ঘনিষ্ঠ” তকমা দিয়ে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তার কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রমনা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আশিক সাঈদ বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে সংযুক্ত আছেন, কিন্তু এখনো তার ন্যায্য পদোন্নতি হয়নি।
অন্যদিকে একই ব্যাচের মেধাবী কর্মকর্তা আবদুল মাবুদ (দুলাল)কেও পদোন্নতি থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর বঞ্চিত রাখা হয়। অভিযোগ ছিল, ২০০৪ সালে তারেক রহমান কুমিল্লায় একটি সম্মেলনে গেলে এএসপি হিসেবে তিনি প্রটোকল দিয়েছিলেন—এমন একটি ছবিকে ভিত্তি করে তাকে রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বলে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তদন্তে প্রমাণিত হয়, সেটি ছিল তার দায়িত্বের অংশ। ৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তনের পর তাকে এসপি ও পরে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে উন্নীত করা হলেও তার ব্যাচের বহু কর্মকর্তা এর আগেই ডিআইজি হয়েছেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জাহিদুল হাসানও একই বৈষম্যের শিকার। শেখ হাসিনা সরকার তাকে পদোন্নতি দেয়নি, কারণ তার ভাই হাসিব ছিলেন লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব। জাহিদুলের নিজের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না থাকলেও কেবল পারিবারিক কারণে তার ক্যারিয়ার আটকে যায়।
এভাবে ১৫ থেকে ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত শতাধিক কর্মকর্তা বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় রয়েছেন তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতির জন্য।
সরকার পরিবর্তনের পরও এই প্রবণতা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। নতুন সরকারের সময়েও ব্যুরোক্রেটিক জটিলতা ও ফাইলবন্দি প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে পদোন্নতির বিষয়গুলো ঝুলে আছে।
চলতি বছরের ২৯ মে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে ২৯টি ডিআইজি পদের জন্য পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই ফাইল নড়েনি। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) একাধিক বৈঠক হলেও সেখানে পুলিশের পদোন্নতি নিয়ে আলোচনা ওঠেনি। সর্বশেষ ১৯ আগস্টের সভায় বিষয়টি আলোচনায় এলেও সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা পেন্ডিং রাখা হয়।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম সরকার পরিবর্তনের পর আমাদের মূল্যায়ন হবে। কিন্তু এখনো সেই একই চিত্র। পদ ফাঁকা, তবু পদোন্নতি নেই। এতে মনোবল ভেঙে যাচ্ছে।”
আরেকজন বলেন, “আগে বলা হতো—গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেগেটিভ, তাই পদোন্নতি আটকে আছে। এখন তো ইতিবাচক প্রতিবেদন জমা পড়েছে। তবু কেন ফাইল চাপা পড়ে আছে?”
বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অনেকেই মনে করছেন, দ্রুত পদোন্নতি প্রক্রিয়া না খুললে এটি পুলিশের মনোবল ও কর্মদক্ষতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, “এই অসন্তোষ যদি স্থায়ী হয়, তা আগামী নির্বাচনের সময় প্রশাসনিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হতে পারে।”
এই বিষয়ে মন্তব্য জানতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং আইজিপিকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কেউ সাড়া দেননি। তবে অতিরিক্ত আইজিপি (প্রশাসন) একেএম আওলাদ হোসেন নিশ্চিত করেছেন, “অতিরিক্ত আইজিপি পদে একটি এবং ডিআইজি পদে ৩২-৩৩টি পদ বর্তমানে ফাঁকা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতির বিষয়ে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে ডিআইজির পদোন্নতি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।”
পুলিশ বাহিনী বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অনিয়ম ও বৈষম্যের কারণে এই বাহিনীর ভেতরে বহু বছরের অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ জমে আছে। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড বা দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিয়ে পদোন্নতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। বর্তমান সরকারের আমলে সেই ঐতিহ্য ভাঙার প্রত্যাশা থাকলেও এখনও বাস্তবে তা প্রতিফলিত হয়নি।
একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি মন্তব্য করেছেন, “বাহিনীর পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির নীতি বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই। তা না হলে পুলিশের ভেতরে যে হতাশা জমছে, তা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক অস্থিরতার রূপ নিতে পারে।”
১৫, ১৬, ১৮ ও ২০তম ব্যাচের শতাধিক কর্মকর্তা আজও অপেক্ষা করছেন তাদের ন্যায্য পদোন্নতির। তাদের দাবি, “আমরা দল করি না, দেশ ও জনগণের পক্ষে কাজ করি।” কিন্তু রাজনৈতিক পক্ষপাতের শিকার হয়ে তারা বছরের পর বছর পিছিয়ে পড়েছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও সেই অবিচারের ছায়া যেন পুরোপুরি কাটছে না। ফাইলের স্তূপে আটকে থাকা পদোন্নতির তালিকা এখন পুলিশের ভেতরে হতাশা, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



