ছবি: সংগৃহীত
রাজ্য-সংস্কার ও নির্বাচন পূর্ববর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বলবৎ „জুলাই জাতীয় সনদ‑২০২৫’ (July National Charter 2025) প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু এর হঠাৎ পরিবর্তন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং গণভোট-সংক্রান্ত সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বিশ্বের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি এই প্রক্রিয়ায় একগুঁয়ে হয়ে পড়েছে; দলটির দাবি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (নেকম) জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
এই সংকটের গভীরতা, বিশেষজ্ঞদের মত, শুধু বিএনপির নিষ্টুর প্রতিক্রিয়া নয় — বরং এটি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা নতুন পর্বের সূচনা হতে পারে। নিচে প্রসঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ দেওয়া হলো।
১৭ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে রাজধানীর পার্লামেন্ট ভবনের সাউথ প্লাজায় সদ্যপ্রণীত “জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫” স্বাক্ষর করা হয়বলে সংবাদ আসে।
নেকম ইতিমধ্যে একাধিক পর্বে আইন-বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক দল ও গবেষক-মণ্ডলীর সঙ্গে আলোচনা করেছে।
সনদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সংবিধান সংস্কার, পার্লামেন্টের ভূমিকা, উচ্চকক্ষ গঠন, গণভোটের আবেদনসহ বেশ কিছু মৌলিক সংশোধনী।
কিন্তু: বিএনপি বলছে, “যে সনদ বলে স্বাক্ষর করানো হয়েছে, চূড়ান্ত সনদের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।”
-
তারা অভিযোগ করছে, কমিশন শুধু অংশ-দলগুলোর মতামত নিয়েছে, বৃহত্তর রাজনৈতিক দল ও জনমতকে বাদ দিয়েছে।
-
বলছেন, নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি ও ভিন্নমত) সনদের চূড়ান্ত সুপারিশে স্থান পায়নি — যা ঐকমত্য হওয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক ঘাটতি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন: “অবাক হয়ে দেখি … নোট অব ডিসেন্টগুলো নেই! পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে, ইগনোর করা হয়েছে। এটা তো ঐকমত্য হতে পারে না। তাহলে ঐকমত্য কমিশনটা করা হয় কেন?”
এর পাশাপাশি বিএনপির অন্যান্য নেতা উচ্চারিত করেছেন, সনদ-বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় ব্রেকডাউন ঘটছে — জাতীয় ঐক্যের বদলে অনৈক্য তৈরি হচ্ছে।
-
জামায়াতে ইসলামী সনদ-প্রসঙ্গ নিয়ে এনসিপি-বিএনপি-বিভাগে ভিন্ন রূখে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত বলছে, “গণভোটের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা নয়; আগে গণভোট ঠিক করা হোক।”
-
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, “সনদে সই করার আগে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দেখা উচিত ছিল; বিএনপি তাড়াহুড়ো করেছে।”
-
বাম ধরনের দল ও গন-অধিকার আন্দোলনের প্রতিনিধিরা বলছেন, ২৭০ দিন বা ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান-সংশোধন পরিষদ গঠন করে ‘স্বয়ংক্রিয়ভাবে’ সংশোধনী সংবিধানে যুক্ত করার প্রস্তাব এক ধরনের বিপজ্জনক ধারায় যাচ্ছে।
বিশ্লেষক ও আইন-বিশেষজ্ঞরা এই সঙ্কটকে শুধু রাজনৈতিক বিভাজনের বিষয় বলছে না — তারা বলছে, রূপ নেয় নতুন সংকটের।
-
আইন-প্রফেসর কামাল আহমেদ মন্তব্য করেছেন, “চালু রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশ সনদে অংশ নিয়েছে, কিন্তু গঠনমূলক আলোচনায় অংশ নেয়নি; ফলত এটি এক ধরনের ‘মনের মধ্যে একমত নয়’ এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”
-
অন্য এক বিশ্লেষক বলেন, “সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট-প্রক্রিয়া যদি সংবিধান-সাপেক্ষভাবে না হয়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ আরও সংহত হবে, এবং জনপ্রিয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
নেকমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে:
-
“সনদ বাস্তবায়নের জন্য আগ্রহী রাজনৈতিক দল-গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং ৪৮টি সংশোধনীর আয়োজনে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পথ রেখেছেন — যেমন: অধ্যাদেশ, এক্সিকিউটিভ অর্ডার, রেফারেন্ডাম, বিশেষ সংবিধানিক আদেশ।”
-
তারা সুপারিশ করেছে, সংবিধান সংশোধন পরিষদ গঠন করা হবে পরবর্তী সংসদের সঙ্গে, এবং ২৭০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ না হলে সংশোধনী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।
-
সনদে নোট অব ডিসেন্ট বাদ পড়েছে — যা দলীয় ভিন্নমত প্রকাশ করার সুযোগ সংকুচিত করছে।
-
গণভোট-প্রস্তাব ও সংসদ নির্বাচন একসাথে বা ভিন্ন সময়ে হবে কি না — সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
-
উচ্চকক্ষ (Upper House) গঠনের প্রস্তাব রয়েছে — ১০০ সদস্যবিশিষ্ট, বিচ্ছিন্ন নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে স্থাপন প্রায় নিশ্চিত। বিশ্লেষকরা বলছেন, “ভোট-সংখ্যানুপাতে উচ্চকক্ষ হবে কি না” তা নিয়েও বিভেদ আছে।
-
প্রায় একরকম সময়সীমা দেওয়া হয়েছে (২৭০ দিন) — যা মেনে না চললে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধনী কার্যকর হবে; এই ধরনের বিধান বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে বিরল।
-
রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হতে পারে: বিএনপিসহ বড় দুই ধরণের দল ও অন্য গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন বেড়েছে।
-
সনদ-বাস্তবায়নার অনিশ্চয়তা নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণভাবে করতে পারে; নতুন সংসদে কাজ শুরু হলেও জনমতের বিশ্বাস কমতে পারে।
-
যদি সনদ-প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয় তবুও আইনগত ভিত্তি দৃঢ় না হয় — তাহলে তা সাংবিধানিক দ্বিধায় পড়তে পারে।
-
দীর্ঘমেয়াদে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় হুমকির সৃষ্টি হতে পারে।
বিএনপির ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া শুধুই একটি দলীয় ঘোষণা নয় — এটি একটা বড় রাজনৈতিক সংকেত যে, “নেতৃত্ব পরিবর্তন” বা “সংস্কার” নিয়ে যতই কথা বলা হোক, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, আইনগত ভিত্তি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা না থাকলে তা – প্রচলিত কথায় বললে – বহুতে বহুবচনেই “কাগজে লেখা কথা” হয়ে পড়বে।
জুলাই সনদ-২০২৫ যদি সত্যিই জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে সময়ের মধ্যে স্পষ্ট ও অংশগ্রহণমূলক বাস্তবায়ন দেখতে হবে। অন্যথায়, এটি বিভাজন ও অস্থিরতার নতুন অঙ্কুর হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



