ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত বর্তমান ও সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থনৈতিক জালিয়াতি, প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করার অনুমোদন দিয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোট ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা অনুমোদন করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন ১০ জন সরকারি কর্মকর্তা এবং ৫ জন ব্যবসায়ী।
দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত-১) আক্তার হোসেন বৃহস্পতিবার এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে যে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা সরকারি ক্ষমতা ও দায়িত্বের অপব্যবহার করে বিপুল অঙ্কের অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগসাজশে রাজস্ব ফাঁকি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতি ঘটিয়েছেন।
দুদকের অনুমোদিত মামলায় যাদের নাম রয়েছে, তারা হলেন—চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন, মো. জাহাঙ্গীর আলম, বাসুদেব পাল, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. আব্দুর রাজ্জাক, দিদারুন নবী, সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রনি বড়ুয়া ও মো. আরিফুর রহমান, বর্তমান রাজস্ব কর্মকর্তা ফারহানা আকরাম, এবং বর্তমানে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট করপোরেট কার্যালয় রাজশাহীতে কর্মরত সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান।
এদের পাশাপাশি বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে অভিযুক্ত হয়েছেন—অন্তরা করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মো. মুশতাক খান, মেসার্স এ. অ্যান্ড জে. ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের অংশীদার মো. আবদুল জলিল আকন ও মো. আলতাফ হোসেন, মেসার্স প্যান বেঙ্গল এজেন্সির মো. সেলিম, এবং জিআর ট্রেডিং করপোরেশন সিঅ্যান্ডএফ লিমিটেডের মো. আব্দুল রহিম।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অভিযুক্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে কাস্টম হাউসের বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে সরকারি রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া বিকৃত করে ব্যক্তিগত লাভবান হওয়ার জন্য জাল কাগজপত্র তৈরি, মূল্য ঘোষণায় কারসাজি, অবৈধ ছাড়পত্র প্রদান, এবং বিদেশি পণ্যের আমদানি-রপ্তানির সময় নথি জালিয়াতির মতো গুরুতর অপরাধে জড়িত ছিলেন।
তদন্তে আরও দেখা গেছে, এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ সরকারি পদে থাকাকালীন সময়ে নিজেদের বা পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন, যার কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। অপরদিকে, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ভুয়া ইনভয়েস, অতিমূল্যায়ন বা কমমূল্যায়নের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রের বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে এনেছে।
দুদক জানিয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৬, ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১ ও ১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব ধারায় আত্মসাৎ, প্রতারণা, জাল নথি প্রণয়ন, ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
এই ধারাগুলোর আওতায় অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে—যেমন দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড, জরিমানা এবং রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ। বিশেষ করে ৪০৯ ধারার অধীনে সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্বে থেকে আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আজীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
দুদকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। এখানে রাজস্ব আদায় ও শুল্ক ছাড়ের ক্ষেত্রে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। কমিশন বেশ কিছু সময় ধরে তাদের আর্থিক লেনদেন ও সম্পদ অনুসন্ধান করেছে, যার ভিত্তিতে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, মামলা অনুমোদনের পর শিগগিরই চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা দায়ের করা হবে এবং অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাব, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, বিদেশ ভ্রমণ ও পাসপোর্ট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুপারিশ করা হবে।
অভিযোগের এই ধারাবাহিকতার পর সরকারি মহল ও রাজস্ব বোর্ডের অভ্যন্তরে কাস্টম হাউস ব্যবস্থাপনা সংস্কারের দাবি আবারও জোরালো হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দেশের রাজস্ব আহরণের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে দুর্নীতির প্রতিটি ঘটনা সরাসরি জাতীয় রাজস্ব আয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।”
তারা মনে করছেন, ডিজিটাল মনিটরিং, ইলেকট্রনিক ট্র্যাকিং, এবং কর্মকর্তাদের সম্পদ ঘোষণার বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ ধরনের অনিয়ম রোধ সম্ভব।
দুদকের এই মামলার অনুমোদনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতির বিস্তৃত নেটওয়ার্ক উন্মোচিত হলো বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। এখন কমিশনের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে—অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করা এবং রাষ্ট্রের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থ পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



