ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থায় এক নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে, যা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কাঠামোর গভীরে থাকা দুর্বলতা উন্মোচিত করেছে। সর্বশেষ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে কেনা একটি সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ২৫ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর উপশাখার এক অ্যাকাউন্ট থেকে। পরবর্তীতে ওই অর্থ ঢাকার শ্যামলী শাখা থেকে উত্তোলন করা হয়।
তদন্তে জানা গেছে, ভুক্তভোগী ব্যক্তি গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস থেকে ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ক্রয় করেন। তার ব্যাংক হিসাব ছিল অগ্রণী ব্যাংকের জাতীয় প্রেস ক্লাব শাখায়। কিন্তু মাত্র চার দিন পর, সোমবার সকালে সেই সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে টাকা চলে যায় সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো, একই কৌশলে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মাধ্যমে ৩০ লাখ এবং এনআরবি ব্যাংকের মাধ্যমে ২০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে অর্থ হাতানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্ক নজরদারির কারণে শেষ দুই লেনদেন থেমে যায় ঠিক সময়ে, অন্যথায় মোট প্রতারণার পরিমাণ অর্ধকোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত।
সরকারের ঋণের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পরিচিত সঞ্চয়পত্রে এখন পর্যন্ত ৩ লাখ ৪০ হাজার ৭১ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, সঞ্চয় অধিদপ্তর, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও পোস্ট অফিসসহ প্রায় ১২ হাজার অফিস থেকে এসব সঞ্চয়পত্র কেনা ও ভাঙানো হয়।
সঞ্চয় ব্যবস্থাটি এখন সম্পূর্ণ সার্ভারভিত্তিক, যেখানে প্রতিটি শাখার নিজস্ব ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহক কোনো পরিবর্তন বা উত্তোলনের আবেদন করলে তার মোবাইলে একটি ওটিপি (One Time Password) পাঠানো হয়, যা তিনি উপস্থিত থেকে কর্মীকে জানালে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় সংশ্লিষ্ট গ্রাহকরা জানিয়েছেন, তারা কোনো আবেদনই করেননি, এমনকি কোনো ওটিপিও পাননি।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে—এই অর্থ উত্তোলন সার্ভার হ্যাকের মাধ্যমে হয়েছে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই তিনটি ঘটনার মধ্যে কারিগরি প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সার্ভারের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রের তথ্য ও অ্যাকাউন্ট নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে, তবে সেটা বাহ্যিক হ্যাকিং নাকি অভ্যন্তরীণ অসাধু চক্রের সহযোগিতায় ঘটেছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ঘটনার পরপরই অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও এনআরবিসি ব্যাংক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন শাখা মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে এবং মামলা দায়েরের প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যেসব তিন কর্মকর্তা ওই সঞ্চয়পত্র বিক্রির সময় সার্ভারের পাসওয়ার্ড ব্যবহারের অনুমতি পেতেন, তাদের তাৎক্ষণিকভাবে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নতুন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রাথমিক তদন্তে এনআরবিসি ব্যাংকের দিনাজপুর উপশাখার একটি অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করেছে, যেখানে টাকা স্থানান্তর হয়। সেই অ্যাকাউন্ট খোলার তথ্য, জাতীয় পরিচয়পত্র ও অন্যান্য ডকুমেন্ট ইতিমধ্যে জব্দ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ঢাকার শ্যামলী শাখা থেকে যে ব্যক্তি টাকা তুলেছেন, তার পরিচয় শনাক্তে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, ফুটেজে দেখা যায় এক ব্যক্তি কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুরো টাকা তুলে নিয়ে চলে যান। তার পরিচয় যাচাইয়ে গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।
আগে সঞ্চয়পত্র কেনা-বেচা ও সুদ প্রদানের পুরো প্রক্রিয়া ছিল ম্যানুয়াল। তখন একই ব্যক্তি বিভিন্ন শাখা থেকে একাধিক সঞ্চয়পত্র কিনলে তা শনাক্ত করা কঠিন ছিল। পরে পুরো ব্যবস্থা অনলাইনে নেওয়া হয়—যার মাধ্যমে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনার সীমা নির্ধারণ করা হয়। এই ডিজিটাল সার্ভার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা, কিন্তু সাম্প্রতিক প্রতারণা প্রমাণ করছে যে এর নিরাপত্তা স্তর পর্যাপ্ত নয়।
ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং মতিঝিল থানায় জিডি করা হয়েছে। সফটওয়্যার হ্যাকের মাধ্যমে এ জালিয়াতি ঘটেছে, নাকি অন্য কোনোভাবে তথ্য বিকৃত করে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে কিছুটা সময় লাগবে।”
তিনি আরও জানান, “সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত প্রতিটি লেনদেনে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট থাকে। সেটি অনুসরণ করে আমরা লেনদেনের পথ ট্র্যাক করছি। অপরাধীদের শনাক্ত করা গেলে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রীয় সঞ্চয় ব্যবস্থায় এ ধরনের জালিয়াতি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট করতে পারে। কারণ, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, যারা নিরাপদ বিনিয়োগের আশায় এখানে অর্থ রাখেন।
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সত্যিই সার্ভার হ্যাক হয়ে থাকে, তবে এটি সরকারের আর্থিক তথ্যভান্ডার নিরাপত্তার বড় সংকেত। তারা বলছেন, সার্ভার অ্যাক্সেসের ক্ষেত্রে মাল্টি-লেভেল অথেনটিকেশন ও লগ মনিটরিং সিস্টেম জোরদার না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের জালিয়াতি ঘটতে পারে।
সঞ্চয়পত্র খাতে এখন প্রতিদিন গড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। তাই এই ঘটনার তদন্ত কেবল একটি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড উদঘাটন নয়—বরং রাষ্ট্রীয় আর্থিক সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থার সক্ষমতা পরীক্ষারও বড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



