ছবি: সংগৃহীত
দেশের বাজারে হঠাৎ করেই বড় ধরনের ধস নেমেছে সোনার দামে। এক লাফে প্রতি ভরিতে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) সোনার দাম কমেছে ১০ হাজার ৪৭৪ টাকা। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দরপতন এবং স্থানীয় পর্যায়ে তেজাবী স্বর্ণ বা পিওর গোল্ডের মূল্য কমে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নতুন দরে আগামীকাল বুধবার (২৯ অক্টোবর) থেকে সারা দেশে সোনা বিক্রি হবে নতুন দামে। এতে করে দেশের ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের মধ্যেই সোনার বাজারে এক ধরনের নড়াচড়া দেখা দিয়েছে।
বাজুসের মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) রাতের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এখন থেকে দেশের বাজারে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনা বিক্রি হবে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৮০৯ টাকা দরে। আগে একই মানের সোনার দাম ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ২৮৩ টাকা। অর্থাৎ, একদিনে দাম কমেছে ১০ হাজার ৪৭৪ টাকা।
একইভাবে,
-
২১ ক্যারেটের এক ভরি সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ টাকা,
-
১৮ ক্যারেটের এক ভরি সোনা বিক্রি হবে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫৭২ টাকায়,
-
আর সনাতন পদ্ধতির সোনার ভরি বিক্রি হবে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২৮ টাকায়।
এই মূল্য তালিকা আগামীকাল থেকে কার্যকর হবে বলে জানায় বাজুস।
বাজুসের ব্যাখ্যায় বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে সাম্প্রতিক সময়ে সোনার দর কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতা দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতি কমে আসা, ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা এবং তেলের দাম কমার প্রভাবে বৈশ্বিক বাজারে সোনার চাহিদা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বাজারেও সোনার চাহিদা আগের তুলনায় কিছুটা কম। এই প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। স্থানীয় বাজারে তেজাবী সোনার (পিওর গোল্ড) দর কমে যাওয়ায় বাজুস নিয়ম অনুযায়ী দাম সমন্বয় করেছে।
বাজুসের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতি তিন থেকে সাত দিন পরপর স্থানীয় বাজারে তেজাবী সোনার দাম পর্যালোচনা করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে উত্থান-পতনের সঙ্গে মিল রেখে এই সমন্বয় করা হয়।
একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ী বলেন, “বাজারে সোনার ক্রেতা এখন আগের চেয়ে কম। উৎসব বা বিয়ের মৌসুম না থাকায় চাহিদা কমেছে। তাছাড়া ডলারের দামও কিছুটা কমেছে, ফলে আমদানিকৃত সোনার খরচও কম পড়ছে। সব মিলিয়ে দাম কমার এটি উপযুক্ত সময়।”
বাজারে হঠাৎ এই বড় দাম কমার খবরে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, নিউমার্কেট, উত্তরা, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদসহ দেশের বড় বড় সোনার দোকানগুলোতে আজ থেকেই ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে। অনেকে পুরোনো সোনা বিক্রি না করে অপেক্ষায় ছিলেন—নতুন কম দামে কেনার আশায়।
একজন ক্রেতা বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বিয়ের জন্য সোনা কেনার পরিকল্পনা করছিলাম। দাম এত বেশি ছিল যে কেনা সম্ভব হয়নি। এখন দাম কমেছে, তাই হয়তো এখনই কেনার সময়।”
অন্যদিকে, সোনার দামে বড় পরিবর্তন এলেও রুপার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,
-
২২ ক্যারেট রুপার ভরি ৪ হাজার ২৪৬ টাকা,
-
২১ ক্যারেট রুপা ৪ হাজার ৪৭ টাকা,
-
১৮ ক্যারেট রুপা ৩ হাজার ৪৭৬ টাকা,
-
আর সনাতন পদ্ধতির রুপা ২ হাজার ৬০১ টাকা ভরিতে বিক্রি হবে।
বাজুস জানিয়েছে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে রুপার মূল্যে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় আগের দামই বহাল রাখা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সোনার দাম হ্রাস সাধারণত স্থানীয় বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এতে স্বর্ণালংকারের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, যা খুচরা বাজারে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করে।
অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ আহমেদ বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে সোনার দাম অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি একপ্রকার বাজার থেকে সরে গিয়েছিল। এখন দাম কমায় আবার নতুন করে ক্রেতারা বাজারে ফিরবে, যা সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যে গতি আনবে।”
তবে তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, “এই কমতি সাময়িক হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন—মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, মার্কিন নির্বাচন, আর্থিক নীতির পরিবর্তন—এসবের কারণে আবার দাম বেড়ে যেতে পারে।”
গত কয়েক মাসে সোনার বাজারে প্রায়ই ওঠানামা দেখা গেছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এক ভরি ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রথমবারের মতো ২ লাখ টাকা ছুঁয়ে যায়। এরপর অক্টোবরের শুরুতে সামান্য কমলেও পরে আবার বাড়তে থাকে। অবশেষে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এসে দাম এক লাফে ১০ হাজার টাকার বেশি কমেছে, যা এ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন।
বাজুসের এক সিনিয়র সদস্যের ভাষায়, “এটি বাজারের স্বাভাবিক ওঠানামা। আমরা দেখছি, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরছে। তাই নভেম্বর মাসে দাম আর খুব বেশি কমবে না, বরং স্থিতিশীল থাকবে বলে আশা করছি।”
তবে অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ীই বলছেন, এ পতনের পর যদি আন্তর্জাতিক বাজারে আবার চাহিদা বাড়ে, তবে দাম পুনরায় বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে বছরের শেষ ভাগে যখন বিয়ে ও উৎসবের মৌসুম শুরু হবে, তখন দাম বাড়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
দেশের সোনার বাজারে এ এক বিরল ঘটনা—এক দিনে প্রতি ভরিতে ১০ হাজার টাকার বেশি দাম কমেছে। এতে একদিকে যেমন সাধারণ ক্রেতাদের মুখে হাসি ফুটেছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন হিসাবের চাপ। তবুও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি বাজারের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর সংকেত—কারণ স্বর্ণের প্রকৃত চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য এখন ধীরে ধীরে বাস্তবতার পথে ফিরে আসছে।
আগামীকাল থেকে কার্যকর হওয়া নতুন দামে দেখা যাবে, এই পরিবর্তন ক্রেতা ও বিক্রেতা—দুই পক্ষকেই কেমনভাবে প্রভাবিত করে বাংলাদেশের সোনার বাজারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



