ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গত এক দশকে বিস্তৃত ও বহুমাত্রিক রূপ নিয়েছে। চীনের ১৪০ কোটিরও বেশি ভোক্তার বাজারে প্রবেশাধিকার পেয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শুল্কমুক্ত সুবিধাভোগী দেশ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছে। ২০২০ সাল থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে চীন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শতভাগ পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা কার্যকর হয়, যা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
তবুও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাগজে-কলমে শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকলেও বাস্তবে চীনের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি আশানুরূপ বাড়েনি। বরং বিপরীতে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা, ফলে বাণিজ্য ঘাটতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ১৭০ কোটি ডলার। এর মধ্যে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে দুই হাজার ১১২ কোটি ডলারের পণ্য, আর রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলার—যা দেশের মোট বাণিজ্য ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যিক সম্পর্ক ২০১০ সালের পর থেকে দ্রুত সম্প্রসারিত হয়। সেই সময় দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের মধ্যে, যা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি। কিন্তু প্রবৃদ্ধির এই ধারা মূলত একমুখী—আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশের রপ্তানি এখনো ১ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পার করতে পারেনি।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, পণ্য বৈচিত্র্যের অভাব, এবং চীনের প্রতিযোগিতামূলক শিল্প কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা—এই ব্যর্থতার মূল কারণ। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল ও ফার্মাসিউটিক্যালস—এই তিন খাতে চীনের বিপরীতে প্রতিযোগিতা করা বাংলাদেশের পক্ষে এখনো কঠিন।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, “চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পরিধি সীমিত। গার্মেন্টস বা টেক্সটাইল খাতে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা আমাদের পক্ষে কঠিন, কারণ তারা পোশাকশিল্পে প্রযুক্তি, দক্ষতা ও কাঁচামালে আমাদের থেকে বহু গুণ এগিয়ে।”
বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে উদার। ২০২০ সালে প্রথম ধাপে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয় দেশটি, ২০২২ সালে তা বাড়িয়ে ৯৮ শতাংশে উন্নীত করে। ২০২৩ সালে যুক্ত হয় আরো ৩৮৩টি নতুন পণ্য। তবে এই সুবিধা বাংলাদেশের রপ্তানি কাঠামোয় তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি।
পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, “চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাজার, কিন্তু আমাদের রপ্তানি ঝুড়ি এখনো সীমিত কয়েকটি পণ্যে নির্ভরশীল। তারা যেসব পণ্য আমদানি করে—যেমন হাইটেক পণ্য, ইলেকট্রনিক্স, বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য—সেগুলোর বেশিরভাগ আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে নেই।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হলে আমাদের পণ্যের গুণমান, উপস্থাপনা ও ব্র্যান্ডিংয়ে নতুন মাত্রা আনতে হবে। শুধু পোশাক বা প্রচলিত পণ্য নয়, খাদ্য, ওষুধ, চামড়া, আইটি সেবার মতো খাতেও প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, তৈরি পোশাকের বাইরে চীনের বাজারে বাংলাদেশের জন্য বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফুটওয়্যার, পাট ও পাটজাত পণ্য, সিরামিক, প্লাস্টিক, ওষুধ, হিমায়িত মৎস্য, কাঁকড়া ও কুঁচে, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, তিল, আম, কাঁঠাল ও আইটি সেবায়।
মামুন মৃধা বলেন, “চীন তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রা উন্নয়নের সঙ্গে মানসম্মত চামড়াজাত ও কৃষিপণ্যের দিকে ঝুঁকছে। আমরা যদি মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে পারি, তবে চামড়া, মাছ ও কৃষিপণ্যের রপ্তানিতে বড় সাফল্য আসবে।”
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির জানান, খুলনা অঞ্চল থেকে বর্তমানে সীমিত পরিসরে চীনে হিমায়িত কাঁকড়া ও চিংড়ি রপ্তানি হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানিকারকরা উচ্চ সুদহার, ব্যয়বহুল লজিস্টিকস ও ব্যাংকিং জটিলতায় ভুগছেন।
তিনি বলেন, “ভারত মাত্র ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করে বাংলাদেশকে টেক্কা দিচ্ছে, অথচ আমরা দ্বিগুণ জমি ব্যবহার করেও সমান উৎপাদন পাচ্ছি না। ফিশ-ফিডের দাম ও দুর্যোগের কারণে খরচ বেড়েছে। চিংড়িকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা দিলে এবং রপ্তানি প্রণোদনা দিলে এই খাত নতুন গতি পেতে পারে।”
বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের জন্যও চীনে সুযোগ তৈরি হচ্ছে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা বলেন, “আমাদের বিস্কুট, জুস, কনফেকশনারি পণ্যের রপ্তানি ইতিমধ্যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। চীনে যাওয়ার পথে আমাদের পরিবহন ব্যয়ও কম, কারণ বাংলাদেশ থেকে চীনে আমদানি করা পণ্যের কনটেইনারগুলো খালি ফেরত যায়—এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের ভোক্তা সংস্কৃতি ও রুচি বিবেচনা করে আমাদের পণ্যে উদ্ভাবন আনতে হবে। মান, প্যাকেজিং এবং স্বাদে চীনা বাজারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে বিশাল সুযোগ তৈরি হবে।”
ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “চীন নিজেরাই লো-এন্ড পোশাক উৎপাদনে খুব দক্ষ। তাই একই পণ্য রপ্তানি করে লাভ নেই; বরং আমাদের মিডিয়াম ও হাই-এন্ড সেগমেন্টে মনোযোগ দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “চীনের বাজারে প্রবেশের জন্য ব্র্যান্ডিং, প্রচার ও রপ্তানি কূটনীতিতে নতুন কৌশল দরকার। যেমন ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে আমাদের যেভাবে উপস্থিতি তৈরি হয়েছে, তেমনভাবে চীনের বাজারেও একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে।”
চীনের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাগুলো বড় প্রতিবন্ধকতা। দেশটির নিজস্ব মান সনদ, জটিল ছাড়পত্র প্রক্রিয়া ও ভাষাগত বাধার কারণে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রপ্তানিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ ছাড়া “রুলস অব অরিজিন” বা উৎস বিধি অনুযায়ী, শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে হলে পণ্যের অন্তত ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন বাংলাদেশে হতে হবে—যা অনেক ক্ষেত্রে পূরণ করা কঠিন।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুই দেশ এখন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের পথে এগোচ্ছে। ইতিমধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় হয়েছে। বিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, “এফটিএ হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারসাম্য আসবে বলে আশা করি। তবে পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়ানো জরুরি।”
তবে অর্থনীতিবিদরা এই বিষয়ে সতর্ক। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এফটিএ একটি দ্বিমুখী তলোয়ার। এর ফলে আমাদের বাজার চীনা পণ্যের জন্য আরো উন্মুক্ত হয়ে পড়বে, যা দেশীয় শিল্পের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই চুক্তির আগে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষায় প্রস্তুতি নিতে হবে।”
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, “চীনের মতো বৃহৎ বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি শিল্পোদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে। উৎপাদন খরচে আমাদের সুবিধা আছে—এই শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়ানো জরুরি।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখন সময় এসেছে বাংলাদেশকে চীনের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নিজেদের রপ্তানি কাঠামো পুনর্গঠনের। পণ্যের মানোন্নয়ন, নতুন খাত শনাক্তকরণ, এবং রপ্তানি কূটনীতিতে দক্ষতা বাড়ানোই হতে পারে ঘাটতি কমানোর মূল চাবিকাঠি।
অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ বলেন, “চীনে রপ্তানি বাড়াতে হলে শুধু পণ্য বিক্রি নয়, বরং তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। চীনা কোম্পানি যদি বাংলাদেশে উৎপাদন করে চীনেই রপ্তানি করে, তবে বাণিজ্য ঘাটতি অনেকটা কমে যাবে। আমাদের এখনই সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।”
বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ এখনো অবারিত। কিন্তু সুযোগকে বাস্তব সাফল্যে রূপান্তর করতে প্রয়োজন কৌশল, সক্ষমতা ও দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণ। নতুবা ‘শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা’ শুধু কাগজেই থেকে যাবে—বাস্তবে নয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



