ছবি: সংগৃহীত
হঠাৎ করে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত স্থলবন্দর বেনাপোলে সন্ধ্যা ৬টার পর সব ধরনের আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি—চোরাই ও কাগজপত্রবিহীন পণ্য অনুপ্রবেশ রোধেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে বন্দরজুড়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সীমান্তের দুই পাশে হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক আটকে পড়েছে, ব্যবসায়ী, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা পড়েছেন চরম বিপাকে।
বেনাপোল কাস্টমসের এই আকস্মিক পদক্ষেপে শনিবার রাত থেকেই কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর। বন্দরের আশপাশে দেখা দিয়েছে শত শত ট্রাকের সারি, যার বেশিরভাগই পচনশীল পণ্য যেমন ফল, সবজি, মাছ ও কসমেটিক্স বহন করছে। ট্রাকচালক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সময়মতো পণ্য খালাস না হলে লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হবে।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই সন্ধ্যা ৬টার পর কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, আলোচনায় এমন প্রস্তাব উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক লতা বলেন, “আমাদের সঙ্গে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছিল। তারা সন্ধ্যা ৬টার পর কার্যক্রম বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু আমরা বলেছিলাম—বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ী ও পরিবহন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, কোনো পরামর্শ ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে।”
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, “আমরা বন্দর পরিচালনা করি, কিন্তু কাস্টমস অনুমোদন ছাড়া কোনো পণ্য ছাড় করা সম্ভব নয়। কাস্টমসের এই আকস্মিক সিদ্ধান্তে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে, রাজস্ব আহরণেও বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।”
২০১৭ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক যৌথ সিদ্ধান্তে বেনাপোল-পেট্রাপোল ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে গত বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেশের সব কাস্টমস হাউস ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বেনাপোলে সেই নির্দেশনা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং এবার সময়সীমা আরও কমিয়ে আনা হয়েছে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীদের মতে, এই সিদ্ধান্ত শুধু সরকারের ঘোষণার পরিপন্থীই নয়, বরং সীমান্ত বাণিজ্যের স্বাভাবিক প্রবাহে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। সময়সীমা কমে যাওয়ায় সেই বাণিজ্য এখন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বেনাপোল ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সন্ধ্যা ৬টার পর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এতে শুধু ব্যবসায়ী নয়, সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০ ট্রাক আমদানিমুখী পণ্য প্রবেশ করত। কিন্তু সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ১৮০-২০০ টিতে। এর ফলে প্রতিদিন প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকার পণ্য খালাস আটকে যাচ্ছে, এবং সরকারও কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।”
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী আনারুল ইসলাম বলেন, “কোনো ঘোষণা ছাড়াই সন্ধ্যার পর বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করায় সবাই হতবাক। দুই পাশে শত শত ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, কোটি কোটি টাকার পণ্য ঝুঁকিতে। যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে বিকল্প হিসেবে ভোমরা, হিলি কিংবা সোনা মসজিদমুখী হতে পারেন। এতে সরকারের রাজস্ব আয়ও মারাত্মকভাবে কমে যাবে।”
এই সিদ্ধান্তে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল বন্দরের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “বাংলাদেশের এই একতরফা সিদ্ধান্তে দুই দেশের বাণিজ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন হাজারেরও বেশি ট্রাক পেট্রাপোল বন্দরে আটকে আছে। আগে রাত ১২টা পর্যন্ত বাণিজ্য চালু থাকত, এখন সন্ধ্যা ৬টার পরই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে—এতে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়ছেন।”
তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, দুই দেশের বাণিজ্যিক কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই জটিলতা নিরসনে পদক্ষেপ নেবে। কারণ এভাবে চলতে থাকলে সীমান্তবাণিজ্যের প্রবাহ ভেঙে পড়বে।”
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে একতরফাভাবে সময়সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও পরিবহন খাত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “বেনাপোল হচ্ছে দেশের রাজস্ব আহরণের অন্যতম প্রধান উৎস। এখানে প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। এই বন্দর বন্ধ থাকলে শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, সরকারও বিপুল রাজস্ব হারাবে।”
বন্দর সূত্র জানায়, প্রতিদিন দেড় হাজারেরও বেশি পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে আটকে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই ফল, সবজি, মাছ ও কসমেটিক্সের মতো দ্রুত পচনশীল পণ্য। দীর্ঘ সময় ধরে এসব ট্রাক সীমান্তে আটকে থাকায় পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
এক ট্রাকচালক বলেন, “দুই দিন ধরে দাঁড়িয়ে আছি, কেউ বলছে আজ ছাড়বে, কেউ বলছে কাল। ট্রাকে থাকা ফল এখন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষতির দায় কে নেবে?”
বাণিজ্য সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে বেনাপোল বন্দর তার প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাবে। ব্যবসায়ীরা বিকল্প স্থলবন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে পড়বেন, যা সরকারের রাজস্ব আহরণে বড় ধাক্কা দেবে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে—কেন আগের ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রমের নির্দেশনা উপেক্ষা করে উল্টো সময়সীমা কমানো হলো? ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েকজন অসাধু আমদানিকারক বা এজেন্টের কারণে পুরো বাণিজ্যপ্রক্রিয়া বন্ধ রাখা যুক্তিসঙ্গত নয়। অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া উচিত, কিন্তু সব ব্যবসায়ীর ওপর একই নিয়ম চাপানো অনুচিত।
বর্তমানে বেনাপোল বন্দরের সামগ্রিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। সীমান্তজুড়ে থেমে আছে বাণিজ্যের চাকা। ট্রাকজট, ক্ষতির আশঙ্কা ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তায় এক সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছেছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



