ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নির্বাচনের আগে মোবাইল সিম ব্যবহারে কঠোর নিয়ম আনার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এক ব্যক্তি কতটি সিম নিজের নামে রাখতে পারবেন, তা পুনর্বিন্যাস করে সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা ও অপরাধ দমন সংক্রান্ত ঝুঁকি মোকাবিলায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগেই একজন ব্যক্তির নামে সর্বোচ্চ সাতটি সিম কার্ড রাখার সীমা কার্যকর করা হবে।
রবিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির ১৫তম সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। সভায় উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেক অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে এমন সব সিম ব্যবহার করে, যেগুলোর নিবন্ধিত মালিক আসলে ভিন্ন ব্যক্তি। এতে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এজন্যই আমরা সিম রেজিস্ট্রেশন কাঠামো পুনর্বিন্যাস করছি, যাতে একজন ব্যক্তি সর্বাধিক সাতটি সিম নিজের নামে রাখতে পারেন।”
তিনি আরও বলেন, “একজনের সিম ব্যবহার করে অন্যজন অপরাধ করলে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ঘটনার পর অনুসন্ধানে জানা যায় সিম কার্ডটির রেজিস্ট্রেশনই অন্য কারও নামে। এ কারণে তদন্ত জটিল হয়, অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এজন্যই আমরা নির্বাচন পূর্ব সময়ে সিম কার্ড সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
সভায় দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। নির্বাচনকালীন সময়ে অপপ্রচার, সাইবার অপরাধ, ডিজিটাল প্রতারণা ও জালিয়াতি ঠেকাতে মোবাইল সিম ব্যবহারে স্বচ্ছতা আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “প্রত্যেক মোবাইল অপারেটরকে এনআইডি-ভিত্তিক রেজিস্ট্রেশনের তথ্য হালনাগাদ করতে বলা হবে। যেসব সিম কোনো ব্যক্তি ব্যবহার করছেন না, কিংবা যে সিমগুলো অবৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও জানান, বর্তমানে একজন নাগরিকের নামে একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হওয়ায় অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করছেন। অপরাধীরা ভুয়া বা অন্যের এনআইডি ব্যবহার করে সিম রেজিস্ট্রেশন করে বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করছে—যেমন প্রতারণা, ভুয়া কল, হুমকি, কিংবা মানহানিকর বার্তা পাঠানো। “এই প্রবণতা রোধ করতে হলে ব্যক্তিপ্রতি সিমের সীমা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিদ্ধান্তটি কার্যকর করতে বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) ও মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকেও সম্পৃক্ত করা হবে। বিটিআরসি ইতোমধ্যে সিম নিবন্ধন ব্যবস্থা আরও কঠোর করার সুপারিশ দিয়েছে। প্রতিটি অপারেটরকে ব্যবহারকারীর তথ্য যাচাইয়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে একজন নাগরিক সর্বোচ্চ ১৫টি সিম নিজের নামে রাখতে পারেন। তবে বাস্তবে অনেকেই এই সীমা ছাড়িয়ে একাধিক এনআইডি বা ভুয়া নিবন্ধনের মাধ্যমে অতিরিক্ত সিম ব্যবহার করেন। নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে এটি কমে আসবে সর্বোচ্চ সাতটিতে।
বিটিআরসি কর্মকর্তাদের মতে, সীমা কমানো হলে মোবাইল নেটওয়ার্কের অপব্যবহার কমবে এবং অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। পাশাপাশি অবৈধ ভিওআইপি, অর্থপাচার, অনলাইন জালিয়াতি ও ফিশিং স্ক্যাম কমাতেও এটি সহায়ক হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো বা নির্বাচনী প্রচারণা ব্যাহত করতে প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।
আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা এখন জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। আমরা চাই নির্বাচনকে ঘিরে কোনো অপরাধ যেন যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সংঘটিত না হয়। এজন্য সিম নিবন্ধনসহ সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।”
সভায় আরও জানানো হয়, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান, অস্ত্র ও মাদক পাচার প্রতিরোধে বিজিবি ও র্যাবকে বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি নাগরিক ও পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বাড়ানো হবে নজরদারি।
তবে মোবাইল সিম সীমাবদ্ধতার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সাতটি সিম একজনের জন্য যথেষ্ট, তবে যারা ব্যবসা বা বিভিন্ন টেলিকম সেবা পরিচালনা করেন, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো এই সীমা কম হয়ে যেতে পারে।
একজন টেলিকম বিশ্লেষক বলেন, “নিরাপত্তার স্বার্থে সিম সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তবে এটি করতে হবে যথাযথ যাচাই-বাছাই ও তথ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটা যেন অপব্যবহারের ঝুঁকিতে না পড়ে, সে বিষয়েও সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে।”
অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সিম ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে পারলে নির্বাচনকালে নিরাপত্তা ঝুঁকি অনেক কমবে। বিশেষ করে ফেক কল, ভয়েস মেসেজ, ও সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর ঘটনা কমবে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে সিম রেজিস্ট্রেশন কাঠামোতে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। একজন নাগরিকের নামে সর্বোচ্চ সাতটি সিম রাখার সীমা কার্যকর হলে এটি হবে দেশের মোবাইল টেলিকম ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ। এখন দেখার বিষয়—বিটিআরসি ও অপারেটররা কত দ্রুত এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে, এবং তা কতটা কার্যকরভাবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাইবার অপরাধ দমন করতে সক্ষম হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



