ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমছে, বাজারে আস্থা ফিরছে না, অথচ সমস্যা সমাধানের মূল জায়গা—বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম—দীর্ঘদিন ধরেই আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে বন্দি। মুনাফার আশায় লাখো মানুষ এ বাজারে আসছেন, কিন্তু জ্ঞানের অভাবে কেউই টেকসই লাভ করতে পারছেন না। বরং অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাজার থেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগ শিক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় দেশের পুঁজিবাজার একটি সীমিত পরিসরে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যেখানে তথ্য, সচেতনতা ও দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা অনুপস্থিত।
কেন্দ্রীয় ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৭৯ লাখ ৯৬ হাজার বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে সক্রিয় বিনিয়োগকারী মাত্র ১৬ লাখ ৪২ হাজার ৫৫২ জন। অর্থাৎ ৬০ লাখেরও বেশি অ্যাকাউন্ট নিস্ক্রিয়।
এর মধ্যেও প্রায় ৩ লাখ ৬৮ হাজার অ্যাকাউন্টে কোনো বিনিয়োগই নেই। অন্তত এক লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ আছে—এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা মাত্র ৫ লাখের কম। অথচ ১৫ বছর আগেও এ বাজারে সক্রিয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৩২ লাখের বেশি। এ তথ্যই বলে দেয়—বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে আস্থা কমেছে, বিনিয়োগকারীর আগ্রহে ভাটা পড়েছে, আর নতুন বিনিয়োগকারী আসলেও তারা টিকতে পারছেন না।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এ চিত্র কেবল বাজারের ওঠানামার ফল নয়, এটি বিনিয়োগ শিক্ষার অভাব ও দুর্বল আর্থিক সচেতনতার সরাসরি প্রতিফলন।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০১২ সালে বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচি হাতে নেয় এবং ২০১৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে ‘বিনিয়োগের অ আ ক খ’ নামে একটি শিক্ষা কার্যক্রম। লক্ষ্য ছিল দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত, এমনকি গৃহিণীদেরও বিনিয়োগ শিক্ষার আওতায় আনা।
শুরুতে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে বড় বড় সম্মেলন হয়, প্রতি সপ্তাহে দু’টি অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন—আট বছরে কতজন বিনিয়োগকারী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, সেই পরিসংখ্যানই নেই। বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম স্বীকার করেছেন, “আমরা প্রতি বছর ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষকে বিনিয়োগ শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্য রাখি, তবে প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই।”
বর্তমানে সপ্তাহে দুই দিন অনলাইন প্রশিক্ষণে ১০০ জনের মতো অংশগ্রহণ করে, কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে পাঁচ-সাতজনও থাকেন না। প্রশিক্ষণের মান ও আগ্রহের ঘাটতিই এর কারণ। একাধিক প্রশিক্ষক স্বীকার করেছেন, “এই প্রশিক্ষণগুলো অনেক সময় শুধু ‘দেখানোর জন্য’ হয়। কার্যকর কোনো ফল মেলে না।”
বিএসইসির পাশাপাশি বিনিয়োগ শিক্ষায় কাজ করার জন্য আরও দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়:
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম) – ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত, শেয়ারবাজারে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার লক্ষ্যে।
বাংলাদেশ একাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটস (বিএএসএম) – ২০১৯ সালে গঠিত, বিনিয়োগকারী, ব্রোকারেজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য।
এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই ও সিএসই) নিজেরাও প্রশিক্ষণ আয়োজন করে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব উদ্যোগের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই, নেই মাননিয়ন্ত্রণ। অনেকে স্বীকার করেছেন, “সবাই নিজস্বভাবে করছে, কিন্তু কেউই জানে না আসলে কী শেখানো দরকার।”
বিএসইসির ‘বিনিয়োগের অ আ ক খ’ ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, সেখানে রয়েছে মাত্র ২২টি নিবন্ধ, যার মধ্যে বাংলায় মাত্র ছয়টি। কোনো ভিডিও টিউটোরিয়াল, ইন্টারঅ্যাকটিভ কুইজ, কিংবা গেমিফাইড শিক্ষণ পদ্ধতি নেই। এমনকি নিবন্ধ ডাউনলোড করতেও নিরাপত্তা সতর্কবার্তা আসে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আধুনিক সময়ে যেখানে সারা বিশ্ব অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে কোটি কোটি বিনিয়োগকারীকে দক্ষ করে তুলছে, সেখানে বাংলাদেশের পদ্ধতি রয়ে গেছে “কাগুজে প্রতিবেদনে সীমাবদ্ধ।”
বিএসইসির উপপরিচালক পদমর্যাদার কয়েকজন প্রশিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, “এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য কী, কারা অংশ নিচ্ছে, তারা কীভাবে উপকৃত হচ্ছে—এসবের কোনো পরিকল্পনা নেই।”
তাদের ভাষায়, “অনলাইন প্রশিক্ষণে শতাধিক অংশগ্রহণকারী থাকলেও শেষের দিকে হাতে গোনা কয়েকজন থাকে। কিছু প্রশিক্ষক আন্তরিকভাবে শেখান, কিন্তু বেশিরভাগই কেবল কর্তব্য পালন করেন।”
আরেকজন যোগ করেন, “বছর শেষে শুধু রিপোর্টে লেখা হয়—এ বছর এতগুলো প্রশিক্ষণ হয়েছে। বাস্তব ফলাফল কেউ দেখে না।”
বাসাবোর রুহুল আমীন, একজন খুচরা বিনিয়োগকারী, অংশ নিয়েছেন বিএসইসি, বিআইসিএম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণে। তাঁর অভিজ্ঞতা তিক্ত— “প্রশিক্ষণে শেখায় বিও অ্যাকাউন্ট কী, অথচ আমি বহু বছর ধরে বিনিয়োগ করছি। যারা নতুন, তাদের জন্য দরকার এসব বিষয়। আমাদের দরকার কোম্পানি বিশ্লেষণ, ঝুঁকি ম্যানেজমেন্ট, বাজার মনস্তত্ত্ব শেখানো।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “সব প্রশিক্ষণই বইয়ের ভাষায় চলে, বাস্তব বাজারে কাজ করে না। বাজার চলে কারসাজি চক্রের ইচ্ছায়। দিনের শেষে মানুষ খোঁজে টিপস, বিনিয়োগ শিক্ষা নয়।”
বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচি কতটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে, তা স্পষ্ট হয় সাম্প্রতিক উদাহরণে—‘বিনিয়োগকারী সপ্তাহ ২০২৫’।
৮ অক্টোবর বিএসইসি ভবনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শুধুমাত্র কমিশনের কর্মকর্তা, স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিনিধি ও কিছু ব্রোকার। অথচ “বিনিয়োগকারী সপ্তাহ” নামের এ আয়োজনে কোনো সাধারণ বিনিয়োগকারীই ছিলেন না!
অংশগ্রহণ না করেও প্রতিবেদন জমা হয়েছে, ছবি প্রকাশ হয়েছে, আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, “এমন প্রহসনমূলক আয়োজন বাজারের প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীর আস্থা আরও কমিয়ে দেয়।”
বাংলাদেশে অন্তত কোটি মানুষ সঞ্চয় করার সক্ষমতা রাখেন। কিন্তু তাদের বড় অংশই ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র বা বিমা পলিসিতে টাকা রাখেন। এতে মুনাফা কম হওয়ায় অনেকেই ধোঁকাবাজ সমবায় বা ভুয়া মাল্টিপারপাস কোম্পানির ফাঁদে পড়েন।
অন্যদিকে যারা অল্প পুঁজিতে শেয়ারবাজারে আসেন, তারা দ্রুত মুনাফার আশায় অজ্ঞতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাজারে প্রচলিত গুজব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের “টিপস” এবং “ইনসাইডার টিপস”-এর ওপর নির্ভর করে বিনিয়োগের ফলে তারা বারবার লোকসান গুনছেন।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজুল হক বলেন, “বিনিয়োগ শিক্ষা কেবল লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, এটি আর্থিক আচরণের শিক্ষা। একজন শিক্ষিত বিনিয়োগকারী বাজারের মেরুদণ্ড। সে যুক্তি ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়, যা বাজারকে স্থিতিশীল করে।”
বিশ্লেষকদের মতে, বিএসইসির শিক্ষা কার্যক্রমের কয়েকটি মৌলিক দুর্বলতা রয়েছে—
প্রভাব মূল্যায়নের অভাব: কতজন প্রশিক্ষণ নিয়ে উপকৃত হচ্ছেন, তার কোনো বিশ্লেষণ হয় না।
তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ: বাস্তব উদাহরণ বা বাজার বিশ্লেষণ কম।
ভাষা ও মাধ্যমের সমস্যা: অধিকাংশ কনটেন্ট ইংরেজিতে, যা প্রান্তিক বিনিয়োগকারীদের জন্য দুর্বোধ্য।
ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্টের অভাব: মোবাইল অ্যাপ, ভিডিও টিউটোরিয়াল বা অনলাইন সিমুলেশন নেই।
সমন্বয়ের অভাব: বিএসইসি, ডিএসই, সিএসই, বিআইসিএম ও বিএএসএম—সবাই আলাদা কাজ করছে, একক রোডম্যাপ নেই।
বাজারের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা: ইনসাইডার ট্রেডিং, প্রাইস ম্যানিপুলেশন, লেনদেন কারসাজির মতো বাস্তব বিষয় নিয়ে কোনো প্রশিক্ষণ হয় না।
যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা মালয়েশিয়ার মতো দেশে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা (যেমন SEBI বা SEC) নিয়মিতভাবে ইন্টারনেটভিত্তিক গেম, ভিডিও সিরিজ, সিমুলেটেড ট্রেডিং প্রতিযোগিতা ও রিয়েল-টাইম লার্নিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে বিনিয়োগে দক্ষ করে তুলছে। সেখানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ শিক্ষা এখনো ‘ক্লাসরুম ও বক্তৃতা’ নির্ভর।
দুই দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বিনিয়োগ শিক্ষা এখনো বাস্তব প্রভাবহীন একটি আনুষ্ঠানিকতা। প্রশিক্ষণ আছে, প্রতিবেদন আছে, কিন্তু ফলাফল নেই। বাজারে যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তারা বলছেন—বিনিয়োগ শিক্ষার কথা অনেক, কিন্তু কার্যকারিতা শূন্য।
একজন সাবেক কমিশনারের ভাষায়, “বিনিয়োগ শিক্ষা যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হতো, তাহলে আজ আমাদের বাজারে ভীতি নয়, যুক্তি কাজ করত। বিনিয়োগকারীরা লোভ নয়, বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর করত। সেটাই একটি স্থিতিশীল বাজারের চাবিকাঠি।”
যত দিন বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচি কেবল ‘ফাইলবন্দি আনুষ্ঠানিকতা’ হয়ে থাকবে, তত দিন শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরবে না—এটাই এখন বাস্তবতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



