
ছবি: সংগৃহীত
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অংশ হিসেবে রাজস্ব প্রশাসনের কার্যক্রমেও দ্রুত পরিবর্তন এনেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। করদাতাদের জন্য আয়কর দাখিল প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক, সহজ ও সময়সাশ্রয়ী করতে অনলাইন রিটার্ন (ই-রিটার্ন) ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৫-২৬ করবর্ষে ইতোমধ্যে সাড়ে ৮ লাখের বেশি করদাতা অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন, যা ডিজিটাল কর ব্যবস্থায় করদাতাদের অংশগ্রহণ ও আগ্রহের এক নতুন রেকর্ড বলে মন্তব্য করেছে এনবিআর।
বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর জানায়, ই-রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধি করদাতাদের আস্থা ও সুবিধার প্রতিফলন। এনবিআর বিশ্বাস করে, সময়ের সাথে সাথে এই সংখ্যা আরও বাড়বে, বিশেষ করে নতুন করে চালু হওয়া প্রবাসী করদাতাদের জন্য ই-মেইলভিত্তিক ওটিপি সুবিধার কারণে।
দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে থাকা করদাতারা অনলাইন রিটার্ন দাখিলের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছিলেন। মূল সমস্যা ছিল ওটিপি বা ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড পাওয়া। আগে ই-রিটার্ন পোর্টালে নিবন্ধনের সময় করদাতাদের ওটিপি পাঠানো হতো বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোবাইল নম্বরে, যা অনেক প্রবাসীর পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হতো না। এতে অনেকে দেশে এসে রিটার্ন দাখিল করতেন, বা প্রতিনিধি মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতেন।
এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানে এবার এনবিআর প্রবাসীদের জন্য এক নতুন পথ উন্মুক্ত করেছে। এখন থেকে প্রবাসীরা তাদের নিজস্ব ই-মেইল ঠিকানায় সরাসরি ওটিপি পেয়ে অনলাইনে রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। এর ফলে তারা বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে, যেকোনো সময় নিজের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন—দেশে না ফিরেই।
এনবিআর জানায়, বিদেশে থাকা করদাতারা এখন তাদের পাসপোর্ট নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ভিসার সিলের কপি, ই-মেইল ঠিকানা এবং ছবি সংযুক্ত করে [email protected] ঠিকানায় আবেদন পাঠাতে পারবেন। আবেদন যাচাই শেষে এনবিআর তাদের ই-মেইলে ওটিপি ও নিবন্ধন লিংক পাঠাবে। এর মাধ্যমে তারা ই-রিটার্ন পোর্টালে সহজেই নিবন্ধন সম্পন্ন করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন এই সুবিধা চালুর ফলে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ অনেক বাড়বে। অনেক প্রবাসী নাগরিক দেশে সম্পত্তি, ব্যবসা বা ব্যাংক বিনিয়োগের মাধ্যমে আয় করেন, কিন্তু নিয়মিত কর দাখিলে জটিলতার মুখে পড়েন। ই-মেইলভিত্তিক ওটিপি ব্যবস্থা চালু হওয়ায় তাদের জন্য অনলাইনে কর দাখিল এখন অনেক সহজ, নিরাপদ এবং সময় বাঁচানো।
এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল আমিন শেখ বলেন, “আমরা চাই প্রবাসী করদাতারা দেশের রাজস্ব প্রক্রিয়ায় আরও সহজে যুক্ত হোন। এজন্য প্রযুক্তিগত বাধাগুলো দূর করা ছিল জরুরি। এখন তারা তাদের নিজস্ব ই-মেইল দিয়েই রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন—এটি এনবিআরের ডিজিটাল সংস্কারের বড় পদক্ষেপ।”
এনবিআর জানিয়েছে, অনলাইন রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ কাগজবিহীন ও ঝামেলামুক্ত। করদাতারা অনলাইন পোর্টালে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করে রিটার্ন জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে acknowledgment slip এবং আয়কর সনদ সংগ্রহ ও প্রিন্ট করতে পারেন। এতে করদাতার সময়, খরচ ও কাগজের ব্যবহার তিনই কমেছে।
প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হওয়ায় কর অফিসে হাজির হওয়ার প্রয়োজন নেই, এবং করদাতারা যেকোনো স্থান থেকে ল্যাপটপ বা মোবাইলের মাধ্যমে রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। এনবিআর বলছে, এটি করদাতাদের জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন, যা রাজস্ব ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে সহায়ক হবে।
২০২৫-২৬ করবর্ষে এনবিআর অনলাইনে রিটার্ন দাখিলকে আরও বিস্তৃত করেছে। এবার থেকে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী প্রবীণ করদাতা, শারীরিকভাবে অক্ষম বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি, বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি এবং দেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিক ছাড়া সকল করদাতার জন্য অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এই বাধ্যবাধকতার ফলে কর ব্যবস্থায় ডিজিটাল পরিবর্তনের গতি বেড়েছে। করদাতারা নিজেরাই ই-রিটার্ন পোর্টালে লগইন করে তথ্য দিতে পারেন, এবং প্রয়োজনে পোর্টালের “লাইভ চ্যাট সাপোর্ট” বা ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন থেকে সহায়তা নিতে পারেন।
এনবিআর জানিয়েছে, প্রবাসীদের জন্য চালু করা এই নতুন সুবিধার বিষয়ে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোকে অবহিত করা হয়েছে। দূতাবাসগুলো প্রবাসী করদাতাদের ই-মেইলভিত্তিক রিটার্ন নিবন্ধনে সহায়তা করবে এবং সচেতনতা কার্যক্রম চালাবে, যাতে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সব করদাতাকে ২০২৫-২৬ করবর্ষের আয়কর রিটার্ন আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ই-রিটার্ন পদ্ধতিতে জমা দিতে আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাষায়, “দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন, এখন করদাতারা মাত্র কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে নিজের কর দাখিল করতে পারবেন।”
বিশ্লেষকদের মতে, এনবিআরের এই উদ্যোগ শুধু করদাতাদের সুবিধা বাড়াবে না, বরং রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থাকেও আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলবে। আগামী দিনে বাংলাদেশের কর সংস্কৃতিতে ই-রিটার্ন হবে প্রধান স্তম্ভ—এমন প্রত্যাশাই এখন দেশ-বিদেশের করদাতাদের মধ্যে।
বাংলাবার্তা/এসজে