ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সৃষ্ট বাণিজ্যিক বিপর্যয় মোকাবিলায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে আসন্ন শুক্র ও শনিবার (সাপ্তাহিক ছুটি) দিনেও ২৪ ঘণ্টা শুল্কায়ন কার্যক্রম চালু থাকবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বুধবার (২২ অক্টোবর) জারি হওয়া এক অফিস আদেশে সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটির দিনেও উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের আদেশ অনুযায়ী, আগামী শুক্রবার ও শনিবার বিমানবন্দরের অধিক্ষেত্রভুক্ত ‘এয়ারফ্রেইট ইউনিট’ ও ‘এক্সপ্রেস সার্ভিস ইউনিটে’ আমদানি, রপ্তানি ও ব্যবসায়িক পণ্য ছাড়করণ কার্যক্রম স্বাভাবিক সময়ের মতোই চলবে। এই দুই ইউনিটে তিন শিফটে (প্রভাতি, দিবা ও নৈশ) কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে—যেখানে উপকমিশনার ও সহকারী কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তারা রাজস্ব কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সাব-ইন্সপেক্টর ও সিপাইদের নিয়ে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করবেন। পুরো কার্যক্রম যুগ্ম কমিশনারদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের এক কর্মকর্তা জানান, ছুটির দিনগুলোতেও কার্যক্রম সচল রাখার এই সিদ্ধান্ত এসেছে সরাসরি রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে। কারণ, শনিবারের অগ্নিকাণ্ডে হাজারো টন আমদানি ও রপ্তানি পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দেশীয় উৎপাদন ও বাণিজ্য শৃঙ্খল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থায় শুল্কায়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখাই এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার।
অগ্নিকাণ্ডের পরদিন থেকেই কাস্টমস হাউসের সব শাখায় জরুরি বৈঠক হয়। এরপর মঙ্গলবার তিনটি পৃথক আদেশে কর্মকর্তাদের সময় ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। বিশেষ করে ‘কার্গো ভিলেজ’, ‘এক্সপ্রেস কুরিয়ার’, এবং ‘এয়ারফ্রেইট’ ইউনিটে জরুরি সেবা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের এক যুগ্ম কমিশনার বলেন, “আগুনের ঘটনায় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এখন প্রধান লক্ষ্য হলো আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে কোনো ধরনের স্থবিরতা না আসতে দেওয়া। এজন্য ২৪ ঘণ্টা ভিত্তিতে টিম গঠন করা হয়েছে, যাতে পণ্য ছাড় ও রাজস্ব আদায় অব্যাহত থাকে।”
এর আগে সোমবার (২০ অক্টোবর) বিভিন্ন খাতভিত্তিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে কাস্টমস কার্যক্রম সপ্তাহজুড়ে চালু রাখার আহ্বান জানান। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিকেএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিজিপিএমইএ, লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস অ্যাসোসিয়েশন, ফুট অ্যান্ড ভেজিটেবলস অ্যাসোসিয়েশন, ফার্মাসিউটিক্যালস অ্যাসোসিয়েশন, জুয়েলারি এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, সুয়িং থ্রেড, ফ্রোজেন ফুডস, প্লাস্টিক গুডস, সিল্ক গুডস, হস্তশিল্প, ক্রাফট অ্যান্ড গিফ্টওয়্যারসহ প্রায় ১৫টি খাতের নেতারা।
তারা জানান, শনিবারের ভয়াবহ আগুনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস, রেডিমেড গার্মেন্টস, চামড়া ও পাদুকা, এবং প্লাস্টিক শিল্প খাত।
বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, “আমাদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল ওই অগ্নিকাণ্ডে ভষ্মে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যেই যদি কাস্টমস হাউস দুই দিনের জন্য বন্ধ থাকে, তাহলে পুরো শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়া থেমে যাবে। তাই ২৪ ঘণ্টাই শুল্কায়ন কার্যক্রম চালু রাখতে হবে—প্রয়োজনে আমরা অতিরিক্ত খরচও বহন করতে রাজি।”
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তে নেমেছে একাধিক সংস্থা। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। একই সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) কারণ অনুসন্ধানে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন শুরু করেছে।
গত শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট টানা সাত ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে সম্পূর্ণ নেভাতে সময় লাগে প্রায় ২৭ ঘণ্টা। এই ঘটনায় হাজারো টন রপ্তানি প্রস্তুত পণ্য, কাঁচামাল এবং ব্যক্তিগত কুরিয়ার মালামাল পুড়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে এই বিপর্যয় শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতিই নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অংশীদারদের আস্থায়ও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সরকারের দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং কাস্টমস হাউসের এই ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম চালুর সিদ্ধান্ত ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
একই সঙ্গে রাজস্ব বোর্ড আশা করছে, এ উদ্যোগের ফলে পণ্য ছাড় ও রাজস্ব আদায় উভয়ই দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে এবং জানিয়েছে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস। তারা মনে করছে, সপ্তাহজুড়ে শুল্কায়ন কার্যক্রম চালু থাকলে উৎপাদন ও রপ্তানি খাতে ধাক্কা কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুনের পর ঢাকা কাস্টমস হাউসের ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম চালুর এই পদক্ষেপ শুধু জরুরি প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং দেশের সামগ্রিক বাণিজ্য প্রবাহ টিকিয়ে রাখার এক অত্যাবশ্যক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



