
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া পণ্যের শুল্ক ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটি জানিয়েছে, যেসব আমদানিকারক আগেই ওই পণ্যের শুল্ক, ভ্যাট ও অন্যান্য কর পরিশোধ করেছিলেন, তারা আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই অর্থ ফেরত পাবেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেবে না এনবিআর; বরং সেই দায়ভার নিতে হবে পণ্য সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানকে।
এনবিআরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) সংস্থার অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শুল্ক ফেরতের প্রক্রিয়া হবে কাস্টমস আইন, ২০২৩-এর ২৮ ধারার আলোকে, যেখানে দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে কর ছাড় বা ফেরতের বিধান স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
কাস্টমস আইন, ২০২৩-এর ২৮ ধারার উপধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পণ্য নামানোর সময় বা তার আগেই নষ্ট হয়ে যায়, অথবা পরীক্ষার আগে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়—এবং যদি পণ্যের মালিক বা তার প্রতিনিধির কোনো অবহেলা না থাকে—তাহলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ক্ষতির মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে শুল্ক ছাড় বা ফেরতের অনুমোদন দিতে পারেন।
একই আইনের আরও একটি ধারা অনুসারে, যদি আমদানিকৃত পণ্য দেশের ভেতরে ব্যবহারের জন্য খালাসের আগে দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নষ্ট হয়, তাহলে আমদানিকারককে ক্ষতির প্রমাণসহ আবেদন করতে হবে। এরপর কাস্টমস কমিশনার মনোনীত একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে পণ্যের নতুন মূল্যায়ন করা হবে, এবং মূল্য যতটুকু হ্রাস পাবে, সেই অনুপাতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হবে অথবা আগেই পরিশোধিত হলে তা ফেরত দেওয়া হবে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, “যেসব পণ্যের শুল্ক পরিশোধের পর কিন্তু খালাসের আগে পুড়ে গেছে, কাস্টমস আইন অনুযায়ী এনবিআর সেই শুল্ক ও কর ফেরত দিতে বাধ্য। এটি কেবল প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি আইনগত বাধ্যবাধকতা।”
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আইনের বিধি-বিধান গভীরভাবে পর্যালোচনা করছি। আইন অনুযায়ী যে পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটিই নেওয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি এনবিআরের আওতার বাইরে। তবে শুল্ক ও কর ফেরতের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হবে।”
চেয়ারম্যান আরও বলেন, “আমরা চাই ব্যবসায়িক কার্যক্রম দ্রুত স্বাভাবিক হোক। যেসব আমদানিকারক বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা যেন আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্রুত আবেদন করেন। কাস্টমস হাউসগুলোকে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হবে, যাতে দ্রুত যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হয়।”
এর আগে সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি (বিপিএমএ) জানায়, শাহজালালের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় ৪৫টি ওষুধ কোম্পানির প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।
বিপিএমএ সভাপতি নাজমুল হাসান (এমপি) বলেন, “এই আগুনে দেশের ওষুধ শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। কাঁচামালের এমন ক্ষতি আমাদের উৎপাদন শৃঙ্খলে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। আমরা সরকারকে ১৪টি প্রস্তাব দিয়েছি যাতে ভবিষ্যতে এমন সংকট এড়ানো যায়।”
তাদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল—পুড়ে যাওয়া পণ্যের বিপরীতে আগে পরিশোধিত শুল্ক, ভ্যাট, ডিউটি এবং অন্যান্য কর ফেরত দেওয়া; একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের এলসিসংক্রান্ত ব্যাংক চার্জ ও সুদ মওকুফ করা।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, “পণ্যের আর্থিক ক্ষতি পূরণের দায়ভার এনবিআরের নয়। কার্গো ভিলেজে পণ্য সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। যদি তাদের অবহেলায় ক্ষতি হয়ে থাকে, তাহলে আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের দায় নির্ধারণ করা হবে।”
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা ও অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। একাধিক তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ক্ষতির কারণ, দায়ী ব্যক্তি এবং ক্ষতিপূরণের সম্ভাব্য দায়—সবকিছুই তদন্তে উঠে আসবে।”
গত ১৮ অক্টোবর (শনিবার) দুপুরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা কার্গো ভিলেজজুড়ে, যেখানে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের পণ্য, বিশেষত ওষুধশিল্পের কাঁচামাল, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, পোশাক ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী মজুত ছিল।
দীর্ঘ ২৭ ঘণ্টা চেষ্টার পর রোববার বিকেলে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। অগ্নিনির্বাপক কর্মীদের পাশাপাশি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরাও আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেন।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি) প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, ওই অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে। সংস্থাটি বলেছে, “এই অগ্নিকাণ্ড শুধু আমদানিকারক নয়, রপ্তানি কার্যক্রমেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে যেসব পণ্য পুনঃরপ্তানির জন্য সংরক্ষিত ছিল, সেগুলোর ক্ষতি বিশাল অর্থনৈতিক ধাক্কা।”
বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন বলছে, এমন ঘটনায় ব্যবসায়িক আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষত ওষুধ, ইলেকট্রনিকস ও টেক্সটাইল খাতের আমদানিকারকরা উদ্বিগ্ন। তারা দ্রুত ক্ষতিপূরণ, শুল্ক ফেরত এবং বিকল্প সংরক্ষণ ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “আমরা চাই সরকার জরুরি ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াক। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতি মেটানো জরুরি না হলেও, শুল্ক ও ভ্যাট ফেরত পাওয়া তাদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এনবিআর জানিয়েছে, পুড়ে যাওয়া পণ্যের মালিকদের শুল্ক ফেরতের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা হবে। প্রতিটি আবেদন যাচাই-বাছাই করে কাস্টমস কমিশনারের অনুমোদনের পর ফেরতের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের কাস্টমস হাউসে ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ না হয়।
একজন জ্যেষ্ঠ কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই না ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেমে যাক। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত চললেও, সমান্তরালভাবে আমরা ব্যবসায়ীদের জন্য শুল্ক ফেরতের প্রশাসনিক প্রক্রিয়া চালু করছি।”
দেশের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং দেশের বাণিজ্য ও শিল্পখাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাকেও নগ্ন করে দিয়েছে। এখন দেখা যাক—আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এনবিআর কত দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে