
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোটি কোটি টাকার পণ্য পুড়ে যাওয়ার ঘটনার পর দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে যেন কোনো স্থবিরতা না আসে, সে লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। বিমানবন্দরের অধিক্ষেত্রাধীন এয়ারফ্রেইট ইউনিট ও এক্সপ্রেস সার্ভিস ইউনিটে একটানা ২৪ ঘণ্টা তিন শিফটে কার্যক্রম চালুর নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তকে কাস্টমস কর্মকর্তারা দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের তাৎক্ষণিক পুনরুদ্ধার পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনারের নির্দেশে এই অফিস আদেশ জারি করেন জয়েন্ট কমিশনার সুমন দাশ। নির্দেশে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোতে সহকারী কমিশনার ও উপকমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রভাতী, দিবা ও নৈশ—এই তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি, রাজস্ব কর্মকর্তা, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা, সাব-ইন্সপেক্টর ও সিপাই পর্যায়ের কর্মীদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হবে, যাতে কোনো সময়েই কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ না থাকে।
কাস্টমসের কর্মকর্তারা জানান, বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অস্থায়ীভাবে আমদানি ও রফতানি কার্যক্রমে কিছুটা ধীরগতি দেখা দিলেও, এই নতুন ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে কার্যক্রম দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসবে। তারা মনে করেন, ব্যবসায়ীদের পণ্য খালাসের প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে এবং বাণিজ্যের গতি পুনরুদ্ধারে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একজন সিনিয়র কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো পণ্য খালাস ও ছাড়পত্র প্রদানে কোনো বিলম্ব না হওয়া। দুর্যোগের প্রভাব যেন বাণিজ্যচক্রে না পড়ে, সেজন্য ২৪ ঘণ্টা কাস্টমস কার্যক্রম চালু রাখা অত্যন্ত জরুরি ছিল।”
সূত্র জানায়, এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে বিমানবন্দর এলাকায় পণ্য পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও ছাড়পত্র প্রদানের প্রক্রিয়া আরও গতিশীল হবে। এয়ারলাইন কোম্পানি, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্টদের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করে কার্যক্রম চলবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সময়সীমা কমবে, পণ্য পরিবহনে গতি বাড়বে এবং রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা আরও জানান, বিশেষ করে এয়ারফ্রেইট ইউনিটে এখন প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ইলেকট্রনিকস, মেডিকেল ইকুইপমেন্ট, পোশাক ও ওষুধ আমদানি হয়। এসব পণ্যের বেশিরভাগই সময়-সংবেদনশীল। তাই কার্যক্রমে কোনো বিলম্ব হলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসায়ী, এবং তার প্রভাব পড়ে পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায়। নতুন তিন শিফটভিত্তিক ব্যবস্থা চালুর ফলে এমন ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোও কাস্টমস হাউসের এই দ্রুত পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলছেন, সংকটের সময়ে এই উদ্যোগ সরকারের দায়বদ্ধতা ও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার প্রমাণ বহন করে।
ঢাকা কাস্টমস হাউস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, “কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের পর সবাই দুশ্চিন্তায় ছিল, পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেবে কিনা। কিন্তু কাস্টমসের দ্রুত পদক্ষেপে আমাদের সেই আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে। এই কার্যক্রমের ফলে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং আমরা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা সবাই উপকৃত হব।”
তিনি আরও বলেন, “২৪ ঘণ্টা কাস্টমস খোলা থাকলে ব্যবসায়ীরা তাদের সময় ও খরচ দুটোই বাঁচাতে পারবেন। আগের মতো ফাইল আটকে থাকা বা কর্মকর্তা অনুপস্থিতির কারণে বিলম্বের সুযোগ থাকবে না।”
কাস্টমস কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই ধারাবাহিক কার্যক্রম বাণিজ্যের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়েও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, দীর্ঘসূত্রতা কমে গেলে পণ্য খালাস দ্রুত সম্পন্ন হবে, ফলে রাজস্ব প্রবাহও বাড়বে।
উল্লেখ্য, গত সপ্তাহে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বিপুল পরিমাণ আমদানি পণ্য পুড়ে যায়। এতে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চালান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। সেই প্রেক্ষিতেই জরুরি ভিত্তিতে এই উদ্যোগ নেয় ঢাকা কাস্টমস হাউস।
বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম শুধু সাময়িক সংকট মোকাবিলা নয়, বরং এটি যদি স্থায়ীভাবে বজায় থাকে, তাহলে বাংলাদেশের এয়ার কার্গো বাণিজ্যে এক নতুন গতি আসবে। অনেক দেশেই এ ধরনের ‘রাউন্ড-দ্য-ক্লক’ কাস্টমস অপারেশন চালু রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে সহায়ক।
ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনারের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভবিষ্যতে এই মডেলকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার চিন্তাভাবনাও চলছে। যদি এই উদ্যোগ সফল হয়, তাহলে চট্টগ্রাম ও বেনাপোল কাস্টম হাউসেও ধীরে ধীরে একই ধরনের শিফটভিত্তিক ২৪ ঘণ্টা কার্যক্রম চালু করা হতে পারে।
দুর্যোগ-পরবর্তী এই উদ্যোগকে প্রশাসনিক তৎপরতা ও বাণিজ্যিক পুনরুদ্ধারের সফল সমন্বয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, “এটি শুধু এক দিনের ব্যবস্থা নয়, বরং আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ—বাংলাদেশের বাণিজ্যচক্র থেমে থাকে না, থেমে যেতে পারে না।”
বাংলাবার্তা/এসজে