
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতির দৃষ্টি এখন এক জায়গায়—আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার পর থেকেই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের প্রার্থী বাছাইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে নেমেছে। দলের লক্ষ্য—নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করা।
এই লক্ষ্যে কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত একাধিক সমন্বিত জরিপ, প্রার্থী যাচাই-বাছাই এবং অভ্যন্তরীণ সমঝোতার কাজ চলছে জোরেশোরে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশের প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বিএনপির অন্তত পাঁচ থেকে দশজন করে সম্ভাব্য প্রার্থী সক্রিয়ভাবে মাঠে রয়েছেন। তাঁদের মধ্য থেকেই বাছাই করে প্রাথমিক মনোনয়ন তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।
গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নির্বাচন ও প্রার্থী তালিকা প্রণয়নের বিষয়টি ছিল আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যিনি বৈঠকের সভাপতিত্বও করেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, স্থায়ী কমিটির সদস্যরা নির্বাচনের প্রস্তুতিকে “অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি” হিসেবে বিবেচনা করেছেন। দলের বিভিন্ন স্তরে প্রার্থী নিয়ে বিরোধ বা কোন্দল মেটাতে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একক প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তারেক রহমান।
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “দল যাঁকেই প্রার্থী করবে, তাঁর জন্যই সবাইকে একযোগে মাঠে নামতে হবে। ধানের শীষের পক্ষে কাজ করাই এখন দলের মূল লক্ষ্য।”
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, তারেক রহমানই দলের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবেন। এই তালিকা প্রণয়নের সময় জেলা ও মহানগর পর্যায়ের নেতাদের মতামত, মাঠপর্যায়ের তথ্য এবং তৃণমূল জরিপের ফল বিবেচনা করা হবে।
বিএনপির নেতারা স্বীকার করেছেন, দেশের প্রায় প্রতিটি আসনেই দলের একাধিক যোগ্য ও সক্রিয় নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশী। অনেক জায়গায় এই সংখ্যা ১০-১২ জন পর্যন্ত পৌঁছেছে। তবে নেতৃত্ব চাইছে, প্রার্থী ঘোষণার পর যেন কোনো বিভাজন না ঘটে এবং সবাই ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “একই আসনে একাধিক প্রার্থী থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজনকেই মনোনয়ন দিতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে, আমাদের লক্ষ্য ব্যক্তিগত জয় নয়—ধানের শীষের জয়। দল ক্ষমতায় এলে যাঁরা বঞ্চিত থাকবেন তাঁদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আন্দোলনের সময় কে কতটা অবদান রেখেছেন, কার বিরুদ্ধে কত মামলা, কে এলাকায় জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন—এসব বিষয় প্রার্থী বাছাইয়ে বিবেচনায় আসবে।”
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়—যদি অক্টোবর মাসের মধ্যেই তালিকা প্রকাশ সম্ভব না হয়, তবে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। এই তালিকা হবে প্রাথমিক, অর্থাৎ তফসিল ঘোষণার পর ও মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় পর্যন্ত এ তালিকায় পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, আগেভাগে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করলে নির্বাচনী এলাকায় তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ তৈরি হবে। যদি দেখা যায় কোনো প্রার্থী মাঠে প্রত্যাশিত সাড়া পাচ্ছেন না, তবে সেই আসনে বিকল্প প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে।
দলের এক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, “আগাম ঘোষণা দিলে নেতাকর্মীরা সময়মতো একক প্রার্থীর পক্ষে সংগঠিত হতে পারবেন। তফসিল ঘোষণার আগেই মাঠে ঐক্য গড়া সম্ভব হবে।”
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়েও আলোচনা চলছে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জোটের পক্ষ থেকে ২৪৪টি আসনের দাবি ইতিমধ্যে বিএনপির কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে বিএনপি মনে করছে, জনপ্রিয়তা ও জয়ের সম্ভাবনা বিবেচনায় আসন ছাড়তে হবে।
একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, “আন্দোলনের সময় যারা আমাদের সঙ্গে ছিল, তাদের মূল্যায়ন করতেই হবে। কিন্তু মূল্যায়ন করতে গিয়ে যেন আসন হাতছাড়া না হয়, সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে।”
জোটের প্রার্থীদের নাম প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না, তা নিয়েও আলোচনায় ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রথমে শুধুমাত্র বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করা হোক, পরে জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আসন চূড়ান্ত করা হোক।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ইতিমধ্যে তিন স্তরে প্রার্থী যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করেছে।
১️⃣ প্রথম পর্যায়ে জেলা ও উপজেলা কমিটির সুপারিশ নেওয়া হচ্ছে।
২️⃣ দ্বিতীয় পর্যায়ে তৃণমূল নেতাদের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হচ্ছে।
৩️⃣ তৃতীয় পর্যায়ে একটি বিশেষ টিম ভোটারদের মধ্যে জরিপ চালাচ্ছে—কোন প্রার্থী সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য তা নির্ধারণের জন্য।
এই কাজের সমন্বয় করছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, যিনি বলেন, “আমরা সর্বত্র খোঁজ নিচ্ছি। তৃণমূল, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমনকি সাধারণ জনগণের সঙ্গেও কথা বলা হচ্ছে—কে বেশি জনপ্রিয়, কে এলাকায় গ্রহণযোগ্য, সেটি জানতেই এই জরিপ।”
রিজভী আরও বলেন, “বিএনপি এবার যোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও মাঠে সক্রিয় প্রার্থীদেরই মনোনয়ন দেবে। জনগণের মন জয় করতে পারলেই প্রার্থী হবেন।”
যেসব জেলায় একাধিক প্রার্থী রয়েছেন, সেখানে কোন্দল নিরসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। গত রবিবার সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি সেখানে স্পষ্ট নির্দেশ দেন— “দল যাঁকেই প্রার্থী ঘোষণা করবে, তাঁর পক্ষেই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। যদি বিশৃঙ্খলা বা বিভাজন তৈরি হয়, তাহলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এই বৈঠকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত প্রচারণার চেয়ে দলের প্রতীক ও নীতির পক্ষে কাজ করতে হবে। দল চায়, সব নেতাকর্মী যেন ভোটারদের কাছে ধানের শীষের প্রতীককে একমাত্র প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, সব আসনে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু দলের প্রতি আনুগত্য ও অবদানের মূল্যায়ন করতেই হবে। এজন্য বিকল্প হিসেবে সংরক্ষিত নারী আসন, টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীত্ব কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে বঞ্চিত নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা চলছে।
দলীয় এক নেতা বলেন, “মনোনয়ন না পেলেও অনেককে সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামোতে মূল্যায়ন করা হবে। এমন আশ্বাস দিলে কর্মীদের মধ্যে আস্থা থাকবে এবং বিভাজন হবে না।”
দলীয় অভ্যন্তরে সর্বজনীন ঐক্য স্থাপন এখন বিএনপির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগাম প্রার্থী তালিকা ঘোষণা ও মাঠপর্যায়ে সক্রিয়তা বাড়ানোর মাধ্যমে বিএনপি আসন্ন নির্বাচনের আগে সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে।
একজন জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেন, “বিএনপি এখন বুঝেছে, শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে নির্বাচন জেতা সম্ভব নয়। জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ও জনপ্রিয় মুখই জয় এনে দিতে পারে। তাই প্রার্থী বাছাইয়ে এবার তারা অনেক বেশি কৌশলী।”
সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির জন্য নভেম্বর হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ সময়েই জানা যাবে, কারা হচ্ছেন ধানের শীষের সম্ভাব্য মুখ, কীভাবে হবে আসন বণ্টন, এবং দল কতটা ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে যেতে পারবে।
অর্থনীতির মন্দা, রাজনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বিএনপি এখন নির্বাচনমুখী রোডম্যাপ সাজাচ্ছে। দলীয় সূত্রের ভাষায়— “এবার শুধু প্রার্থী নয়, বিএনপি চাইছে এক নতুন বার্তা দিতে—দল ঐক্যবদ্ধ, প্রস্তুত এবং জনগণের ভোটের জন্য মাঠে নামতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ