
ছবি: সংগৃহীত
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উত্তেজনায় ভরপুর ম্যাচ। কখনো বাংলাদেশ এগিয়ে, কখনো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শেষ পর্যন্ত নাটকীয় এক সুপার ওভারে মাত্র ১ রানে জয় তুলে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আর সেই সঙ্গে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখল তারা। ২৩ অক্টোবর তাই সিরিজের শেষ ওয়ানডেটি হয়ে দাঁড়াল কার্যত অঘোষিত ফাইনাল।
এই ম্যাচের রোমাঞ্চ শুরু হয়েছিল মূল ইনিংসের শেষ ওভার থেকেই। এরপর সুপার ওভারের প্রতিটি বল যেন ছিল সাসপেন্সে মোড়া। শেষ পর্যন্ত হারের হতাশায় মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশ, আর ক্যারিবীয়রা হাসল শেষ হাসি।
সুপার ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ে নেমে ১০ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায়। বাংলাদেশের হয়ে দায়িত্ব নেন মুস্তাফিজুর রহমান। প্রথম বলে এক রান দিয়ে ভালো শুরু করলেও দ্বিতীয় বলেই ফিরতি আঘাত হানেন ‘দ্য ফিজ’। শেরফান রাদারফোর্ডকে বোল্ড করে দলকে এগিয়ে দেন তিনি।
তবে এরপর ভাগ্য যেন মুখ ফিরিয়ে নেয় বাংলাদেশের দিক থেকে। চতুর্থ বলে ব্র্যান্ডন কিংয়ের সহজ ক্যাচটি ধরতে ব্যর্থ হন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ। সেই ভুলেরই মাশুল দিতে হয় টাইগারদের। শেষ বলে শাই হোপ দারুণ এক চার হাঁকিয়ে ক্যারিবীয়দের সংগ্রহ দাঁড় করান ১০ রানেই।
১১ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামেন সৌম্য সরকার ও সাইফ হাসান। শুরুটা আশাব্যঞ্জকই ছিল, কিন্তু শেষটা আবারো ‘তীরে এসে তরী ডোবার’ গল্প।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিনার আকিল হোসেনের করা প্রথম বৈধ বলের আগেই ওয়াইড দেন তিনি। এরপর নো বল করে আরও চাপ বাড়ান। ফ্রি হিটে সৌম্য নিতে পারেন মাত্র এক রান। এরপর একের পর এক ডট বল, একটি ক্যাচ, আর বাংলাদেশের আশার প্রদীপ নিভে যায় ধীরে ধীরে।
চতুর্থ বলে সৌম্য সরকারকে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ বানিয়ে ম্যাচে ফেরেন আকিল। শেষ বলে বাংলাদেশের দরকার ছিল ৩ রান। কিন্তু সাইফ হাসান নিতে পারেন কেবল একটি রান। ফলাফল—বাংলাদেশের হেরে যাওয়া এক রোমাঞ্চকর সুপার ওভার।
সুপার ওভারের আগে মূল ম্যাচই ছিল টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। বাংলাদেশের করা ২১৩ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজও সমান রান তুলে ম্যাচ নিয়ে যায় টাইতে।
শেষ ওভারে ম্যাচের ভাগ্য ছিল দু’দলের হাতেই। শেষ ৬ বলে ক্যারিবীয়দের দরকার ছিল ৫ রান, আর বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ২ উইকেট। বল হাতে ছিলেন সাইফ হাসান। প্রথম দুই বলেই আকিল হোসেনকে ডট দিয়ে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনেন তিনি। তৃতীয় ও চতুর্থ বলে সিঙ্গেল নেওয়ায় সমীকরণ দাঁড়ায় ২ বলে ৩ রানের।
পঞ্চম বলে আকিলকে বোল্ড করে বাংলাদেশ শিবিরে আনন্দের জোয়ার এনে দেন সাইফ। কিন্তু সেই আনন্দ স্থায়ী হয়নি। শেষ বলে ব্যাটিংয়ে আসেন খারি পিয়েরে। তার দেওয়া ক্যাচ উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহান ধরতে ব্যর্থ হন। স্কয়ার লেগে দৌড়ে ডাবল নেন পিয়েরে ও শাই হোপ। ম্যাচ তখন সমতায়—আর সেখান থেকেই গড়ায় সুপার ওভারে।
বাংলাদেশের ইনিংসটিও ছিল উত্থান-পতনের গল্পে ভরপুর। টস জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুটা ভালো করলেও মাঝের ওভারে ধারাবাহিকভাবে উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে দল।
শেষ দিকে ব্যাট হাতে ঝড় তোলেন তরুণ অলরাউন্ডার রিশাদ হোসেন। মাত্র ১৪ বলে ৩৯ রানের বিধ্বংসী অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি, যা বাংলাদেশকে নিয়ে যায় ৭ উইকেটে ২১৩ রানে। তার ইনিংসে ছিল চারটি ছক্কা ও তিনটি বাউন্ডারি।
এর আগে ওপেনার সৌম্য সরকার খেলেন ইনিংসের সর্বোচ্চ ৪৫ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস। মেহেদী হাসান মিরাজ যোগ করেন ৩১, নুরুল হাসান সোহান ২৮।
বাংলাদেশের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শুরুতেই চাপে পড়ে। কিন্তু অভিজ্ঞ ওপেনার শাই হোপ একাই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তার ব্যাট থেকে আসে লড়াকু হাফসেঞ্চুরি—যা ক্যারিবীয়দের ম্যাচে টিকে থাকার মূল ভরসা হয়ে ওঠে।
হোপ ৭৪ রানে অপরাজিত থেকে শেষ পর্যন্ত দলকে সমতায় পৌঁছে দেন। তার সঙ্গী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ব্র্যান্ডন কিং (৪১) ও রোভম্যান পাওয়েল (২৯)।
বাংলাদেশের হয়ে মুস্তাফিজ নেন ২ উইকেট, রিশাদ ও সাইফ হাসান পান ১টি করে উইকেট।
ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ দল ও সমর্থকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা—ফিল্ডিং। দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাচ মিস, কয়েকটি মিসফিল্ড, আর শেষ বলের অবিশ্বাস্য ক্যাচ হাতছাড়া—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের হাত থেকে জয় ফসকে যায় অনায়াসেই।
বিশেষ করে শেষ ওভারে উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহানের ক্যাচ মিসটাই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়। মিরাজও সুপার ওভারে ব্র্যান্ডন কিংয়ের ক্যাচ ফেলেন—যা থেকে শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত রান পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে এখন ১-১ সমতা। প্রথম ওয়ানডে জিতে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ, কিন্তু এই হারের ফলে সিরিজের ভাগ্য গড়াবে চূড়ান্ত ও তৃতীয় ওয়ানডেতে, যা অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩ অক্টোবর।
ম্যাচটি এখন কার্যত সিরিজের অঘোষিত ফাইনাল। একদিকে বাংলাদেশের ঘরের মাঠে সিরিজ জয়ের প্রত্যাশা, অন্যদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার লড়াই—দুই দলের সমান প্রেরণা নিয়ে নামার অপেক্ষা।
পরিসংখ্যানের আলোকে
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৭ উইকেটে ২১৩ (রিশাদ ৩৯*, সৌম্য ৪৫)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৫০ ওভারে ২১৩ (হোপ ৭৪*, কিং ৪১)
ফলাফল: ম্যাচ টাই, সুপার ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয়ী ১ রানে
সিরিজ অবস্থা: ১-১ সমতা
পরবর্তী ম্যাচ: ২৩ অক্টোবর, মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম
শেষ পর্যন্ত এই ম্যাচ ছিল শুধুই ক্রিকেট নয়, বরং মানসিক দৃঢ়তা ও ধৈর্যের এক পরীক্ষা। বাংলাদেশ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েও হেরেছে, কিন্তু সমর্থকদের হৃদয়ে তারা রেখে গেছে এক অপূর্ণ প্রত্যাশা—শেষ ম্যাচে সেই অপূর্ণতা পূরণ করবে কি টাইগাররা? ২৩ অক্টোবরই মিলবে উত্তর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ