
ছবি: সংগৃহীত
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে নগর স্থাপত্য, আন্তর্জাতিক ভবন নির্মাণ এবং রেলওয়ের আধুনিকায়ন—বিভিন্ন খাতজুড়ে মোট ১৩টি নতুন উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা।
মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ অবকাঠামো ও নগরায়ণ প্রক্রিয়ায় গতি আসবে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি আরও সুদৃঢ় হবে।
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হবে ১ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭ লাখ টাকা, বৈদেশিক ঋণ থেকে পাওয়া যাবে ৫৩ কোটি ২ লাখ টাকা, এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে ৫০ কোটি টাকা।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘রেজিলিয়েন্স স্ট্রেংদেনিং থ্রো অ্যাগ্রি-ফুড সিস্টেম ট্রান্সফরমেশন’—যার লক্ষ্য দেশের কৃষি ব্যবস্থায় টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা করা এবং কৃষকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা।
এছাড়া খুলনা বিভাগীয় পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ মাটির রাস্তা, সেতু-কালভার্ট ও বাজার অবকাঠামো সংস্কার ও উন্নয়ন করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হবে, কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে খরচ কমবে এবং স্থানীয় অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে।
নগর উন্নয়ন খাতে রয়েছে ‘জামালপুর শহরের নগর স্থাপত্যের পুনঃসংস্কার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প’। এতে জামালপুর শহরের প্রধান সড়ক, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ফুটপাত ও পার্কগুলো আধুনিকীকরণ করা হবে। পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চার জন্য নির্মিত হবে একটি আধুনিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, যেখানে নাট্যচর্চা, সংগীত ও শিল্পকলার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু হবে।
এছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১-৫ নং জোনের অভ্যন্তরীণ রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে শহরের যানজট ও জলাবদ্ধতা কমানোর পাশাপাশি পথচারীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা হবে।
রাজধানীর উত্তরায় দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত উত্তরা লেক উন্নয়ন প্রকল্পকেও অনুমোদন দিয়েছে একনেক। প্রকল্পটির মাধ্যমে লেকের পানি সংরক্ষণ, চারপাশের হাঁটার পথ ও সবুজায়ন উন্নত করা হবে। স্থানীয় বাসিন্দারা যেন লেককে একটি নিরাপদ ও পরিচ্ছন্ন বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন, সে লক্ষ্যে আধুনিক লাইটিং ও সিসিটিভি ব্যবস্থা যুক্ত করা হবে।
একনেকের অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি হলো অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় বাংলাদেশ চ্যান্সারি ভবন নির্মাণ প্রকল্প। দীর্ঘদিন ধরে অস্থায়ী ভবনে বাংলাদেশ হাইকমিশন কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। নতুন ভবনটি নির্মিত হলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডে মর্যাদা ও দক্ষতা দুই-ই বৃদ্ধি পাবে।
একনেক বৈঠকে অনুমোদন পেয়েছে কিশোরগঞ্জ-পাকুন্দিয়া-মির্জাপুর-টোক জেলা মহাসড়ককে যথাযথ মানে উন্নীতকরণ প্রকল্প। এ সড়কটি মধ্যাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় শিল্পকারখানা, কৃষিপণ্য পরিবহন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে গতি আসবে।
রেলওয়ে খাতেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে—রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটগুলোর পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন প্রকল্প। এতে পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলো আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেমে রূপান্তর করা হবে। ফলে দুর্ঘটনা ঝুঁকি কমে যাবে এবং ট্রেন চলাচল আরও নিরাপদ ও সময়নিষ্ঠ হবে।
ঘোড়াশাল ৩য় ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পও অনুমোদিত হয়েছে, যা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পুরনো ইউনিট আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হলে উৎপাদন দক্ষতা বাড়বে এবং জ্বালানি সাশ্রয় হবে।
একনেক অনুমোদিত স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হলো পাবনা মানসিক হাসপাতালকে আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রূপান্তর প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নতুন পর্যায়ে যাবে। আধুনিক চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার একটি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
একনেক বৈঠকে আরও অনুমোদন পেয়েছে বিএসটিআই পদার্থ ও রসায়ন পরীক্ষণ ল্যাবরেটরি সম্প্রসারণ প্রকল্প। এর আওতায় নতুন ল্যাব ভবন, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষণ সুবিধা তৈরি করা হবে, যা বাংলাদেশের পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে।
একনেক সূত্র জানিয়েছে, এই ১৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের দিকে এগোচ্ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও নগর এলাকার উন্নয়নে সমান্তরাল বিনিয়োগ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা এমন প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি যেগুলো সরাসরি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রভাব ফেলবে। গ্রামীণ সড়ক থেকে আন্তর্জাতিক ভবন—সবখানেই আমরা স্থায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে চাই।”
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, অনুমোদিত প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি থাকবে।
এভাবে একনেকের সর্বশেষ বৈঠকে অনুমোদিত ১৩ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন যাত্রা আরও একধাপ এগিয়ে গেল।
বাংলাবার্তা/এমএইচ