
ছবি: সংগৃহীত
রানি এলিজাবেথ, অড্রে হেপবার্ন, কোরাজন একুইনো, রোনাল্ড রিগান এবং আমাদের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছিলেন কোলন ক্যান্সারে। উন্নত বিশ্বে ক্যান্সারে মৃত্যুর দিক থেকে এটি দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে, যদিও উন্নয়নশীল বিশ্বে এই ক্যান্সারের হার তুলনামূলক কম।
কোলন ক্যান্সার সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষদের বেশি হয়ে থাকে। ভয়ানক বিষয় এটাই যে এখন মাত্র ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেও এর প্রকোপ বাড়ছে।
তরুণ রোগীদের মধ্যে অন্যান্য অঙ্গে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার (মেটাস্টেসিস) হারও বেশি। আর বলাই বাহুল্য, এমন পর্যায়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার উপায় থাকে না।
কেন হচ্ছে
তরুণদের মধ্যে কেন বাড়ছে কোলন ক্যান্সারের হার, এ নিয়ে উন্নত বিশ্বে চলছে গবেষণা। তবে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে কোনো কারণ নির্ণয় করা যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় নিচের কারণগুলো :
► স্থূলতা, শরীরচর্চায় অনীহা
► অতিরিক্ত পরিমাণ চিনিসমৃদ্ধ, চর্বিজাতীয় ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ
► লাল মাংস খাওয়া
► খাবারের তালিকায় সবজি, ফল ও ফাইবারের ঘাটতি
► বংশগত বৈশিষ্ট্য
► ডায়াবেটিস
► এক্রোমেগালি নামের হরমোনের ব্যাধি
► পিত্তথলি অপারেশন
► কোলনের পলিপ বা অন্যান্য রোগ, যেমন—ক্রোনস ডিজিস, আলসারেটিভ কলাইটিস
► ছোটবেলায় অন্ত্রে ইসকেরেশিয়া কলাই নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। এটি অন্ত্রে কলিব্যাকটিন নামের রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে। একসময় এই যৌগ কোলনের কোষকে উদ্দীপ্ত করে অনিয়ন্ত্রিত কোষ গঠনে ভূমিকা নেয়।
খাবারের ভূমিকা
কোলন ক্যান্সার সৃষ্টিতে খাবারের রয়েছে তিনটি ভূমিকা :
রাসায়নিক তৈরি : চর্বিজাতীয় খাবার রান্না করলে তৈরি হয় ক্যান্সার তৈরির রাসায়নিক অ্যামাইন।
পাশাপাশি চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণের ফলে পিত্তনালি থেকে প্রচুর পরিমাণ পিত্ত এসিড নিঃসরিত হয়। ফলে মলের মধ্যে ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। এটিও ক্যান্সারের কারণ।
টক্সিন জমে যাওয়া : শাক-সবজি কম খেলে দেহে ফাইবারের ঘাটতি তৈরি হয়। শাক-সবজি শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
অন্ত্রে মলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, শক্ত করে এবং প্রবাহে গতি দান করে। ফলে খাদ্যের অপদ্রব্যগুলো দীর্ঘ সময় কোলনে জমা থাকতে পারে না। ফাইবার গ্রহণ কম করলে মল দীর্ঘ সময় কোলনে জমে থাকে, এতে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
প্রতিরোধক ভিটামিন : ভিটামিন এ, সি ও ই-এর পাশাপাশি ফ্লাভিনয়েড নামের একটি উপাদান কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এগুলোর মূল জোগান দেয় সবজি ও ফল। অতিরিক্ত পিত্তরসের ক্ষতিকর প্রভাব কমায় ক্যালসিয়াম, ফলে এটিও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়ামের চমৎকার উৎস দুধ। ফলিক এসিড ও ওমেগা-৩ ডিএনএর ক্ষয় রোধ করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। এ দুটি উপাদান রয়েছে মাছে, বিশেষত সামুদ্রিক মাছের তেলে।
লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে কোলন ক্যান্সারের কোনো লক্ষণ না-ও থাকতে পারে। দেহের বাঁ পাশে কোলন ক্যান্সার হলে সাধারণত পায়খানার সঙ্গে টাটকা রক্ত ঝরতে পারে এবং অন্ত্র আটকে যেতে পারে। ডান পাশে হলে লক্ষণ দেখা যায় না। পেট ব্যথা, রক্তশূন্যতা ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যা হতে পারে রোগীর। তবে রোগীর ওজন দ্রুত কমে যায়। ক্যান্সার অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে সেসব অংশে এর লক্ষণ দেখা যায়। পেটে চাকা হতে পারে।
কখন সতর্ক হবেন
► দীর্ঘদিন পেটে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি
► মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ, মিশ্রিত কিংবা টাটকা
► মলের ধরন বদলে যাওয়া। কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া
► সব সময় পেট ভরা অনুভব করা
► অজানা কারণে ওজন হ্রাস
► শারীরিক দুর্বলতা
► লৌহ ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা
নির্ণয়
মল পরীক্ষা করে কোলন ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন কোলনোস্কোপি। মলে রক্তের উপস্থিতি থাকলে এই পরীক্ষা করা জরুরি। কোলন ক্যান্সারে অনেক সময় মলের সঙ্গে নিয়মিতভাবে রক্ত যায় না। তাই মল পরীক্ষার পর স্বাভাবিক রিপোর্ট এলেও কোলনোস্কোপি করার প্রয়োজন রয়ে যায়। পাশাপাশি এখন নতুন এক পরীক্ষা চালু হয়েছে, যার নাম কলোগার্ড। মলের নমুনায় হিমোগ্লোবিন, ডিএনএ, কোষের আকৃতিতে পরিবর্তন এবং কোষে কী পরিমাণ ডিএনএ বিদ্যমান তা বিশ্লেষণ করা হয়। এর মাধ্যমে শতকরা ৯২ ভাগ ক্ষেত্রে কোলন ক্যান্সার নির্ণয় করা সম্ভব। তবে এখনো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা কোলনোস্কোপি।
চিকিৎসা
প্রাথমিক পর্যায়ে কোলন ক্যান্সার ধরা পড়লে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি। কিন্তু ক্যান্সার অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দাঁড়ায় শতকরা ৫ ভাগেরও কম। সুতরাং ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয়ের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। অস্ত্রোপচার, কেমো ও ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে এই রোগের চিকিৎসা করা হয়।
প্রতিরোধ
কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য মেনে চলতে হবে কিছু নির্দেশনা :
► চর্বিজাতীয় খাবার ও লাল মাংস কম খেতে হবে
► শাক-সবজি, ফলমূল, ফাইবারজাতীয় খাবার, দুধ ইত্যাদি খেতে হবে নিয়মিত
► দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
► ধূমপান, মদ্যপান পরিহার করা জরুরি
► যাদের পরিবারে এই ক্যান্সারের ইতিহাস রয়েছে তাদের নিয়মিত কোলনোস্কোপি করা জরুরি
► ইসকেরেশিয়া কলাই নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা
বাংলাবার্তা/এমএইচ