
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবি করা ‘শাপলা’ প্রতীক নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও আইনগত পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দলটির অনড় অবস্থান ও পুনঃআবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট আইন-বিধি বিশ্লেষণ করে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি শিগগিরই করা হবে।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এনসিপি ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে শাপলা প্রতীক নিয়ে টানাপোড়েন চলছিল। কমিশন এর আগে দলটিকে জানিয়ে দিয়েছিল, ‘শাপলা’ প্রতীকটি বর্তমানে নিবন্ধিত অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে, ফলে বিকল্প প্রতীক বেছে নিতে হবে। কমিশনের পক্ষ থেকে ৫০টি বিকল্প প্রতীকের তালিকা সরবরাহ করে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
কিন্তু সময়সীমার শেষ দিন, অর্থাৎ শনিবার (১৯ অক্টোবর) দলটির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে পুনরায় ‘শাপলা’ প্রতীকই রাখার আবেদন জানায়। এই আবেদন পাওয়ার পর কমিশন বিষয়টি আবারও আলোচনায় তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
সোমবার (২০ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এনসিপিকে ৫০টি প্রতীকের মধ্যে থেকে একটি পছন্দ করে জানাতে বলেছিলাম। ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। শেষদিন তারা এসে পুনরায় ‘শাপলা’ প্রতীক চেয়ে আবেদন করেছে। কমিশন এখন বিষয়টি আবার পর্যালোচনায় নিচ্ছে। কমিশনই সিদ্ধান্ত নেবে দলটিকে কোন প্রতীক দেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, আইন ও বিধি অনুযায়ী প্রতীকের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটিই চূড়ান্ত হবে। তবে কমিশন চাইছে যেন সিদ্ধান্তটি আইনি, যুক্তিসঙ্গত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হয়, যাতে পরবর্তীতে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক না তৈরি হয়।
এনসিপির পক্ষ থেকে শুরু থেকেই বলা হচ্ছে, শাপলা প্রতীক তাদের দলের রাজনৈতিক ইতিহাস, আদর্শ ও জনপরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই এই প্রতীক থেকে তারা কোনোভাবেই সরে আসবে না।
রোববার সকালে নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এনসিপির প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের জানায়, তারা কোনো “চাপিয়ে দেওয়া প্রতীক” গ্রহণ করবে না। দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশন একটি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আমাদের মনে হচ্ছে এসব সিদ্ধান্ত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা কোনোভাবে চাপিয়ে দেওয়া প্রতীক মেনে নেব না। আমাদের প্রতীক ‘শাপলা’ ফেরত দিতে হবে।”
দলটির নেতারা দাবি করেন, ইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সমতা ও ন্যায়বিচারের নীতি লঙ্ঘন করছে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার পরিপন্থী। তাদের মতে, প্রতীক কেবল ভোটের চিহ্ন নয়, এটি একটি দলের রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতিফলন।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া বিকল্প ৫০টি প্রতীকের তালিকায় ছিল—আলমিরা, খাট, উটপাখি, ঘুড়ি, কাপ-পিরিচ, চশমা, দালান, বেগুন, চার্জার লাইট, কম্পিউটার, জগ, জাহাজ, টিউবওয়েল, টিফিন ক্যারিয়ার, টেবিল, টেবিল ঘড়ি, টেলিফোন, ফ্রিজ, তবলা, বক, মোরগ, কলম, তরমুজ, বাঁশি, লাউ, কলস, চিংড়ি, থালা, বেঞ্চ, লিচু, দোলনা, প্রজাপতি, বেলুন, ফুটবল, ফুলের টব, মোড়া, বালতি, কলা, বৈদ্যুতিক পাখা, মগ, মাইক, ময়ূর, মোবাইল ফোন, শঙ্খ, সেলাই মেশিন, সোফা, স্যুটকেস, হরিণ, হাঁস ও হেলিকপ্টার।
তবে এনসিপি এই প্রতীকগুলোর কোনোটি বেছে নেয়নি এবং জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কাছে এগুলোর কোনোটিই দলের প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, ‘শাপলা’ প্রতীকটি পূর্বে অন্য একটি নিবন্ধিত দলের প্রতীকের সঙ্গে মিল থাকায় এটি বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ফলে আইন অনুযায়ী নতুন দলকে সেই প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া যায় না। তবে এনসিপির যুক্তি হলো, তাদের দল আগে থেকেই ‘শাপলা’ প্রতীক দাবি করে আসছে এবং এর ব্যবহার দীর্ঘদিনের।
এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশন বিষয়টি পুনরায় পর্যালোচনায় নেওয়ায় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কারণ কোনো প্রতীক নিয়ে অনির্দিষ্ট অবস্থান সৃষ্টি হলে তা আসন্ন নির্বাচনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বলেন, “প্রতীক সংক্রান্ত বিরোধ রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। তাই কমিশনের উচিত দলগুলোর মতামত বিবেচনা করে আইনি ভিত্তিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া। অন্যথায় ভবিষ্যতে এটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর আস্থার সংকট তৈরি করবে।”
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কমিশন আগামী বৈঠকেই এনসিপির পুনঃআবেদনের বিষয়টি এজেন্ডায় আনবে। সেখানে আইন-বিধির আলোকে ‘শাপলা’ প্রতীকের ব্যবহার বৈধ কি না, তা যাচাই করা হবে। পর্যালোচনার পর আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, “এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা আইন অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করব। যেটি আইনসঙ্গত হবে, সেটিই অনুমোদন দেওয়া হবে।”
এর মাধ্যমে স্পষ্ট হলো যে, জাতীয় নাগরিক পার্টির দাবিকৃত ‘শাপলা’ প্রতীক পুনরায় বিবেচনায় নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন, এবং এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
দলটি যেভাবে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে—এই প্রতীক ইস্যুতে তারা শেষ পর্যন্তও আপস করতে প্রস্তুত নয়। এখন নজর থাকবে কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে, যেখানে এই প্রতীকের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ