
ছবি: সংগৃহীত
জুলাই সনদ নিয়ে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) হঠাৎ করেই জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান নিয়েছে। দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এক ফেসবুক পোস্টে জামায়াতের চলমান আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির আন্দোলনকে ‘রাজনৈতিক প্রতারণা’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো জাতির গণঅভ্যুত্থানের চেতনা থেকে সংস্কার আলোচনাকে সরিয়ে নেওয়া। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের বক্তব্য নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি। এই অবস্থান রাজনৈতিক মহলে বিস্তর আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ এতদিন এনসিপি জামায়াত ও বিএনপির সংস্কারপন্থি অবস্থানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল।
বিতর্কের সূত্রপাত হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের এক মন্তব্য থেকে। তিনি জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিন ‘জুলাইযোদ্ধা’দের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ প্রসঙ্গে বলেন, “এখানে জুলাইযোদ্ধাদের নামে কিছু ছাত্র নামধারী উচ্ছৃঙ্খল লোক ছিল, যাদের আমি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অনুসারী মনে করি।” এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “সংসদ ভবনের সামনে আহত জুলাইযোদ্ধাদের ফ্যাসিস্ট অনুসারী বলা কেবল অসম্মান নয়, এটি শহীদ পরিবারের প্রতি অশ্রদ্ধা। সালাহউদ্দিন আহমেদকে অবিলম্বে এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হবে।”
সালাহউদ্দিন অবশ্য পাল্টা জবাবে বলেন, “বিএনপিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলছে। কিন্তু এই অপপ্রয়াস সফল হবে না।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই ছোট ঘটনার মধ্য দিয়েই বিএনপি ও এনসিপির সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রকাশ্যে চলে আসে। এর একদিন পরই নাহিদ ইসলাম জামায়াতের বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেন, “জামায়াতের পিআর আন্দোলন একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা, যা সংস্কারের মূল প্রশ্নকে বিকৃত করছে।”
জুলাই সনদ—যেটি মূলত রাজনৈতিক সংস্কারের নীলনকশা হিসেবে উপস্থাপিত—নিয়ে শুরু থেকেই এনসিপি এবং জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। বিএনপি ও জামায়াতসহ ২৫টি দল সনদে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু এনসিপি তা থেকে সরে দাঁড়ায়। নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, “সনদ বাস্তবায়নের আগে আইনি ভিত্তি নির্ধারণ না করে এতে স্বাক্ষর করা কেবল জনপ্রিয়তার রাজনীতি।”
জামায়াত সূত্র বলছে, এনসিপি শুরু থেকেই চাইছিল তারা যেন সনদে স্বাক্ষর না করে। সনদে স্বাক্ষরের আগের দিন এনসিপির শীর্ষ নেতারা জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এবং সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যেন জামায়াতও স্বাক্ষর না করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেয়, বাস্তবায়ন পদ্ধতি অসম্পূর্ণ হলেও সনদে স্বাক্ষর করলে সংস্কার প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে।
একজন জ্যেষ্ঠ জামায়াত নেতা বলেন, “এনসিপির অবস্থান যৌক্তিক হলেও যদি আমরাও সই না করতাম, তাহলে সনদের রাজনৈতিক গুরুত্ব হারাত। আর বিএনপি ও অন্যান্য দল সই করলেও জামায়াত সই না করলে আমাদের সংস্কারপন্থি অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতো।”
নাহিদ ইসলাম তাঁর ফেসবুক পোস্টে আরও লেখেন, “জামায়াত ও তার সহযোগীরা ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রক্রিয়াকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাচ্ছে। পিআর আন্দোলনের নামে তারা নিজেদের দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) প্রশ্নটি গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের মৌলিক প্রশ্ন নয়, বরং এটি ক্ষমতা ভাগাভাগির একটি হিসাব।”
তিনি আরও বলেন, “জামায়াত কখনোই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো অঙ্গীকার দেখায়নি। তারা সংস্কার প্রস্তাব দেয়নি, সংবিধান সংস্কার নিয়ে কোনো দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থাপন করেনি। তাদের হঠাৎ এই অনুমোদন একটি কৌশলগত অনুপ্রবেশ—সংস্কারের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক নাশকতা।”
জামায়াতের পক্ষ থেকে এর জবাবে বলা হয়, নাহিদ ইসলামের বক্তব্য ‘বালখিল্য’ ও ‘ভিত্তিহীন’। এক বিবৃতিতে দলটি জানায়, “পিআর দাবিকে রাজনৈতিক প্রতারণা বলা নিছক বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশল। জামায়াত জাতীয় স্বার্থে সনদে স্বাক্ষর করেছে, যাতে সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত না হয়।”
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, “তরুণদের দল এনসিপি যা ইচ্ছা বলতে পারে। আমরা দায়িত্বশীল দল, তাই উত্তেজনামূলক প্রতিক্রিয়া দেখাব না। সংস্কার ও নির্বাচনের ধারাবাহিকতা যেন বিঘ্নিত না হয়, সেটিই এখন প্রধান লক্ষ্য।”
এনসিপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে তারা জামায়াতের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বিনিময়ে জামায়াত কোনো সমর্থন দেয়নি। এনসিপির প্রধান দাবি ছিল—আগামী সংসদকে গণপরিষদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান সংস্কার করা। কিন্তু জামায়াত এই দাবিকে সমর্থন করেনি।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “জামায়াত ও বিএনপি ক্ষমতা ভাগাভাগির পুরোনো রাজনীতিতে ফিরে গেছে। তারা আইনি ভিত্তিহীন সনদে সই করে সংস্কার আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। এনসিপি আইনি ভিত্তি ছাড়া কোনো সনদ মানে না। আমরা একাই সত্যিকার সংস্কারের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে এনসিপির উদ্যোগে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু আন্দোলন শুরুর আগে এনসিপি ও কয়েকটি দল সরে দাঁড়ায়। তাদের যুক্তি ছিল, জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে আন্দোলনে গেলে তারা ‘ডানপন্থি তকমা’ পাবে।
এরপরও জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি দল জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে রাস্তায় নামে। এনসিপি এতে অংশ নেয়নি। তাদের মতে, “আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল উচ্চকক্ষ গঠন, কিন্তু জামায়াত আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে পুরো নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করার দাবি তোলে, যা রাজনৈতিকভাবে অবাস্তব।”
নাহিদ ইসলাম তাঁর সাম্প্রতিক পোস্টে আরও লেখেন, “জনগণ এখন বুঝে গেছে কারা সংস্কারের নামে প্রতারণা করছে। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, জনগণ আর কোনো ভুয়া সংস্কারবাদী বা ছলনাকারীর দ্বারা প্রতারিত হবে না। এ দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণের, তারা আর কোনো অসৎ ও নৈতিকভাবে দেউলিয়া শক্তিকে শাসনের সুযোগ দেবে না।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির এই ভাষা স্পষ্টতই আক্রমণাত্মক এবং তা শুধু জামায়াত নয়, বিএনপির প্রতিও বিরাগের ইঙ্গিত বহন করছে। এতে ‘সংস্কারপন্থি’ বলয়ে নতুন বিভাজনের সৃষ্টি হতে পারে, যা ভবিষ্যতের নির্বাচনী সমঝোতাকে আরও জটিল করে তুলবে।
তবে তিন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, জুলাই সনদ নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও নির্বাচনী সমঝোতা থেকে কেউই সরে যায়নি। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি—সবাই ভবিষ্যতের বৃহত্তর রাজনৈতিক মিত্রতার দরজা খোলা রেখেছে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সংস্কার আন্দোলনের ‘অভ্যন্তরীণ ভাঙন’ এখন প্রকাশ্যে। একসময় যেসব দল একে অপরের পাশে ছিল, আজ তারা মুখোমুখি। আর জুলাই সনদের ভবিষ্যত বাস্তবায়ন এখন নির্ভর করছে এই বিভাজন মেরামতের ওপর—নাকি এটিই হবে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সূচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ